বিশ্ব

গাজার প্রতিটি শিশুই আমাদের শত্রু: সাবেক ইসরায়েলি আইনপ্রণেতা

ইসরায়েলের চরম ডানপন্থী রাজনীতিবিদ এবং সংসদের সাবেক সদস্য মোশে ফেইগলিন গাজার শিশুদের নিয়ে একটি বিতর্কিত ও উদ্ভট মন্তব্য করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন। স্থানীয় সময় গত বুধবার (২১ মে) ইসরায়েলি টিভি চ্যানেল ১৪-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “শত্রু হামাস নয়, হামাসের সামরিক শাখাও নয়। গাজার প্রতিটি শিশুই শত্রু। আমাদের গাজা দখল করে সেখানে বসতি স্থাপন করতে হবে, এবং সেখানে একটি গাজাবাসী শিশুকেও রাখা যাবে না। এছাড়া অন্য কোনো বিজয় নেই।” এই মন্তব্যের পর থেকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা প্রকাশ পাচ্ছে।

মোশে ফেইগলিনের মন্তব্যের পটভূমি

মোশে ফেইগলিনের এই মন্তব্য এসেছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি চিফ অব স্টাফ ইয়ের গোলানের একটি অভিযোগের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। গোলান সম্প্রতি অভিযোগ করেছিলেন যে, গাজার শিশুদের হত্যা করা ইসরায়েলের জন্য যেন একটি ‘শখ’-এ পরিণত হয়েছে। তিনি আরও বলেছিলেন, ইসরায়েলের বর্তমান নীতি ও কর্মকাণ্ড দেশটিকে এমন একটি রাষ্ট্রে পরিণত করছে, যার আন্তর্জাতিক সমর্থন ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। গোলানের এই সমালোচনার জবাবে ফেইগলিন তার বিতর্কিত মন্তব্যে গাজার শিশুদের ‘শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং গাজায় ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের পক্ষে সাফাই গান।

ইয়ের গোলান এক সংবাদ সম্মেলনে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকারের ভূমিকারও তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, “ইসরায়েল দিন দিন এমন এক রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে, যার আন্তর্জাতিক কোনো সমর্থক নেই। কেননা, সুস্থ কোনো দেশ কখনো বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে না। শখের বশে শিশু হত্যা করে না।” গোলানের এই বক্তব্য ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এবং ফেইগলিনের মতো চরম ডানপন্থী রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া আদায় করেছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

ফেইগলিনের মন্তব্যের পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে তীব্র নিন্দা ও প্রতিক্রিয়া এসেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (OHCHR) এক বিবৃতিতে বলেছে, “শিশুদের বিরুদ্ধে এ ধরনের বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। শিশুরা যুদ্ধের শিকার, শত্রু নয়।” এছাড়া, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই মন্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, বিশেষ করে এক্স প্ল্যাটফর্মে, ফেইগলিনের মন্তব্য নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা চলছে। অনেক ব্যবহারকারী এই মন্তব্যকে ‘মানবতাবিরোধী’ এবং ‘জাতিগত ঘৃণা ছড়ানোর প্রচেষ্টা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। একজন এক্স ব্যবহারকারী লিখেছেন, “শিশুদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা কোনো সভ্য সমাজের রাজনীতিবিদের কথা হতে পারে না। এটি ইসরায়েলের নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতিফলন।”

ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব

ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ফেইগলিনের মন্তব্য তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। চরম ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলো তার এই মন্তব্যের প্রতি সমর্থন জানালেও, মধ্যপন্থী ও বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এটিকে ‘বিপজ্জনক’ এবং ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বলে সমালোচনা করেছে। ইসরায়েলের বিরোধী দলের নেতা ইয়ার ল্যাপিড এক বিবৃতিতে বলেন, “এ ধরনের মন্তব্য শুধু ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং আমাদের নৈতিক মূল্যবোধেরও অবমাননা করে।”

এদিকে, ফেইগলিনের মন্তব্য ইসরায়েলের বর্তমান সরকারের নীতির প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষকে আরও উসকে দিয়েছে। গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান এবং বেসামরিক নাগরিকদের হতাহতের ঘটনা ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক মাসে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিক, যার মধ্যে শিশুর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি, নিহত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ফেইগলিনের মন্তব্য ইসরায়েলের অবস্থানকে আরও দুর্বল করেছে।

গাজার বর্তমান পরিস্থিতি

গাজা উপত্যকা বর্তমানে একটি মানবিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক সংস্থা (OCHA) জানিয়েছে, গাজার বেশিরভাগ বাসিন্দা খাদ্য, পানি, এবং চিকিৎসা সুবিধার তীব্র সংকটের মুখোমুখি। ইসরায়েলের বোমা হামলা এবং সামরিক অভিযানের ফলে হাজার হাজার শিশু তাদের পরিবার হারিয়েছে, এবং অনেকে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে ফেইগলিনের মন্তব্য শুধুমাত্র মানবিক সংকটকে আরও জটিল করছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

ইসরায়েলের ভবিষ্যৎ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

ইসরায়েলের বর্তমান সরকারের নীতি এবং ফেইগলিনের মতো রাজনীতিবিদদের বক্তব্য দেশটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপর গভীর প্রভাব ফেলছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইসরায়েলের ঐতিহ্যবাহী মিত্ররাও গাজার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র বলেন, “আমরা সব পক্ষকে সংযমী হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। বেসামরিক নাগরিকদের, বিশেষ করে শিশুদের, সুরক্ষা নিশ্চিত করা সব পক্ষের দায়িত্ব।”

এদিকে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ফেইগলিনের মন্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছে, এটি ইসরায়েলের ‘ফিলিস্তিনিদের প্রতি ঘৃণার মনোভাব’ এবং ‘জাতিগত নির্মূলকরণের নীতি’র প্রতিফলন। ফিলিস্তিনি মানবাধিকার সংগঠনগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (ICC) কাছে এই মন্তব্যের তদন্ত দাবি করেছে।

উপসংহার

মোশে ফেইগলিনের মন্তব্য শুধুমাত্র ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই নয়, আন্তর্জাতিক মঞ্চেও তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তার এই বক্তব্য গাজার চলমান মানবিক সংকটকে আরও জটিল করেছে এবং ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন ইসরায়েলের কাছে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নীতি গ্রহণের দাবি জানাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কোন দিকে যাবে, তা নিয়ে বিশ্লেষকরা উদ্বিগ্ন।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button