অর্থনীতি

সচিবালয়ে বৈঠক আবারও সরকারি কোম্পানির শেয়ার ছাড়ার তাগিদ

সরকারি মালিকানাধীন বিভিন্ন কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করতে নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, প্রাথমিকভাবে এসব কোম্পানির ৫ শতাংশ শেয়ার পুঁজিবাজারে ছাড়ার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো হবে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি)।

বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় ‘পুঁজিবাজারের উন্নয়নে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা বাস্তবায়ন’ শীর্ষক শিরোনামে। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী। যদিও বৈঠকে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্ব করার কথা থাকলেও তিনি উপস্থিত ছিলেন না। একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, শিল্পসচিব মো. ওবায়দুর রহমান এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানও উপস্থিত ছিলেন না।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ব্যক্তিত্বরা

বৈঠকে অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক এবং আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিরঞ্জন চন্দ্র দেবনাথ উপস্থিত ছিলেন। তারা প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া পাঁচ দফা নির্দেশনার বাস্তবায়ন অগ্রগতি নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন।

আনিসুজ্জামান চৌধুরী বৈঠক শেষে বলেন, “পুঁজিবাজারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর অগ্রগতি পর্যালোচনা করতেই এই বৈঠকের আয়োজন করা হয়। যেসব বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ দরকার, সেগুলো নিয়ে তাৎক্ষণিক কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। অন্যান্য বিষয়গুলো ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে।”

তালিকাভুক্তির প্রস্তাব প্রাপ্ত সরকারি কোম্পানিগুলোর তালিকা

আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি
  • বাখরাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি
  • গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি
  • জালালাবাদ গ্যাস সিস্টেম
  • বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি
  • সোনারগাঁও হোটেল
  • ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি
  • লিকুফায়েড পেট্রোলিয়াম গ্যাস
  • সিলেট গ্যাসফিল্ড
  • পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি
  • রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড
  • প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ
  • চিটাগং ডকইয়ার্ড
  • কর্ণফুলী পেপার মিলস
  • বাংলাদেশ ইনস্যুলেটর অ্যান্ড স্যানিটারিওয়্যার ফ্যাক্টরি
  • আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি
  • ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ
  • বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস
  • টেলিটক
  • টেলিফোন শিল্প সংস্থা (টেশিস)

প্রধান উপদেষ্টার পুঁজিবাজার উন্নয়ন নির্দেশনা

এর আগে, ১১ মে তারিখে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস অর্থ উপদেষ্টা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেন। সেখানে তিনি পুঁজিবাজার সংস্কারে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেন:

  1. যেসব বহুজাতিক কোম্পানিতে সরকারের অংশ রয়েছে, সেগুলোকে দ্রুত শেয়ারবাজারে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।
  2. তালিকাভুক্ত এবং তালিকাভুক্ত নয়, এমন কোম্পানির করহার ব্যবধান বাড়িয়ে বেসরকারি বড় কোম্পানিকে পুঁজিবাজারমুখী করা।
  3. বিদেশি বিশেষজ্ঞ এনে পুঁজিবাজার সংস্কার ত্বরান্বিত করা।
  4. পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ।
  5. বড় কোম্পানিগুলোর দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে ব্যাংকের পরিবর্তে পুঁজিবাজার নির্ভরতা বাড়ানো।

প্রধান উপদেষ্টা এসব নির্দেশনার বাস্তবায়নে ছয় মাস সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যার মধ্যে অগ্রগতি যাচাইয়ের লক্ষ্যেই আজকের বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।

করহারে পরিবর্তনের প্রস্তাব

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এবং তালিকাভুক্ত নয়, এমন কোম্পানির মধ্যে করহারে ব্যবধান বর্তমানে ৫ শতাংশ। বিএসইসি এই ব্যবধান বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছে, যাতে কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে আগ্রহী হয়। আগামী বাজেটে এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।

জোর নয়, প্রণোদনায় পুঁজিবাজারে আনতে চায় সরকার

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, ভালো এবং বড় কোম্পানিগুলো যদি স্বেচ্ছায় বাজারে না আসে, তবে সরকার তাদের ওপর জোর প্রয়োগ করবে না। বরং বিভিন্ন প্রণোদনার মাধ্যমে তাদের আগ্রহী করার পথেই এগোতে চায় সরকার।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকারি কোম্পানিগুলোর শেয়ার ছাড়লে বাজারে আস্থা ফিরবে, বিনিয়োগ বাড়বে এবং বাজারের গভীরতা তৈরি হবে। তবে কার্যকর বাস্তবায়ন ও সুশাসন নিশ্চিত করা না গেলে এই উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে না বলেও সতর্ক করছেন তারা।

উপসংহার

সরকারি কোম্পানির শেয়ার বাজারে আনার এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে যদি স্বচ্ছতা ও সময়ানুযায়ী কার্যক্রম চালানো হয়, তবে দেশের পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা ও আস্থা তৈরি করা সম্ভব হবে। এই ক্ষেত্রে শুধু সরকারি নির্দেশনা নয়, প্রয়োজন সম্মিলিত রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দক্ষ নেতৃত্ব ও বাজারবান্ধব নীতিমালা। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় ও বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়াতে হলে কোম্পানিগুলোর আর্থিক স্বচ্ছতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button