গণঅভ্যুত্থানে সেনানিবাসে আশ্রয় নেয়া ব্যক্তিদের প্রসঙ্গে অবস্থান জানালো সেনাবাহিনী

সম্প্রতি জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এ সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সেনানিবাসে আশ্রয় প্রার্থনার বিষয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের আনুষ্ঠানিক অবস্থান স্পষ্ট করেছে। বৃহস্পতিবার (২২ মে ২০২৫) প্রকাশিত এক বিবৃতিতে সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তৎকালীন সরকারের পতনের পর দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির তীব্র অবনতি ঘটে, যার ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়। এই সংকটময় পরিস্থিতিতে প্রাণ রক্ষার জন্য সেনানিবাসে আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছিল, যা সম্পূর্ণ মানবিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে করা হয়। সেনাবাহিনী জোর দিয়ে বলেছে, এই পদক্ষেপ কোনোভাবেই রাজনৈতিক পক্ষপাত বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়।
গণঅভ্যুত্থান ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তৎকালীন সরকারের পতনের পর কিছু কুচক্রী মহলের তৎপরতায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। সরকারি দপ্তর, পুলিশ স্টেশন, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বাড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগ, চুরি, ডাকাতি এবং মব জাস্টিসের মতো ঘটনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি করে। ফলে, প্রাণ রক্ষার জন্য অনেকে সেনানিবাসে আশ্রয় প্রার্থনা করেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই সংকটময় সময়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ আশ্রয়ের জন্য এসেছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন রাজনৈতিক নেতা, বিচারক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, পুলিশ সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা এবং সাধারণ পরিবার। সেনাবাহিনী পরিস্থিতির তাৎক্ষণিক জটিলতা বিবেচনায় জীবন রক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এই আশ্রয়প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।
আশ্রয়প্রার্থীদের বিবরণ
সেনাবাহিনীর বিবৃতি অনুযায়ী, মোট ৬২৬ জন ব্যক্তি বিভিন্ন সেনানিবাসে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন:
- ২৪ জন রাজনৈতিক নেতা,
- ৫ জন বিচারক,
- ১৯ জন প্রশাসনিক কর্মকর্তা,
- ৫১৫ জন পুলিশ সদস্য,
- বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা,
- ৫১টি পরিবার।
এই আশ্রয় প্রদানের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ মানবিক ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছিল। সেনাবাহিনী স্পষ্ট করেছে যে, এই পদক্ষেপে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা পক্ষপাত ছিল না। আশ্রয়প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সেনাবাহিনী তাদের সাময়িকভাবে আশ্রয় প্রদান করে।
আশ্রয়প্রার্থীদের অবস্থা এবং হস্তান্তর
সেনাবাহিনী জানিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সাথে সাথে অধিকাংশ আশ্রয়প্রার্থী ১ থেকে ২ দিনের মধ্যে সেনানিবাস ত্যাগ করেন। তবে, ৫ জন ব্যক্তিকে তাদের বিরুদ্ধে চলমান মামলা ও অভিযোগের ভিত্তিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে হস্তান্তর করা হয়। এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ স্বচ্ছভাবে এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সম্পন্ন হয়েছে।
২০২৪ সালের ১৮ আগস্ট আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করে এবং আশ্রয়প্রার্থীদের একটি তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এই তালিকা ওই সময়েই মীমাংসিত বলে বিবেচিত হয়। সেনাবাহিনী জোর দিয়ে বলেছে যে, আশ্রয় প্রদানের পুরো প্রক্রিয়া আইনের সীমার মধ্যে এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরিচালিত হয়েছিল।
অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর সতর্কতা
বিবৃতিতে সেনাবাহিনী উল্লেখ করেছে, কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করছে। এই ধরনের অপপ্রচারে বিশ্বাস না করার জন্য জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে সেনাবাহিনী। তারা জানিয়েছে, এই ধরনের তথ্য ছড়ানোর মাধ্যমে কিছু গোষ্ঠী সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্ব এবং জনগণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতার ওপর প্রশ্ন তুলতে চায়।
সেনাবাহিনী জনগণকে আশ্বস্ত করেছে যে, তারা সবসময় সত্যের পক্ষে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষায় অটল রয়েছে। তারা এই ধরনের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের অধিকার সংরক্ষণ করে এবং জনগণকে সঠিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
সেনাবাহিনীর ভূমিকা ও দায়বদ্ধতা
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তার বিবৃতিতে পুনর্ব্যক্ত করেছে যে, তারা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বদা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেনাবাহিনীর মূলমন্ত্র “সমরে আমরা, শান্তিতে আমরা, সর্বত্র আমরা দেশের তরে” এই প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন। গণঅভ্যুত্থানের সময় সেনাবাহিনী শুধুমাত্র জীবন রক্ষার জন্য আশ্রয় প্রদানই করেনি, বরং দেশের আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ইতিহাসে বারবার জাতীয় সংকটে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ বিতরণ, অবকাঠামো নির্মাণ এবং জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ—সেনাবাহিনী সবসময় জনগণের আস্থার প্রতীক হিসেবে কাজ করেছে। গণঅভ্যুত্থানের সময়ও তারা এই দায়বদ্ধতা থেকে বিচ্যুত হয়নি।
অপপ্রচার ও সামাজিক মাধ্যম
সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপপ্রচার ছড়িয়ে পড়েছে। কিছু পোস্টে দাবি করা হয়েছে যে, সেনাবাহিনী রাজনৈতিক পক্ষপাতের ভিত্তিতে আশ্রয় প্রদান করেছে। এই ধরনের দাবি সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে স্পষ্টভাবে খণ্ডন করা হয়েছে। তারা জানিয়েছে, আশ্রয় প্রদানের সিদ্ধান্ত ছিল সম্পূর্ণ পরিস্থিতিগত প্রয়োজনের ভিত্তিতে এবং কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত হয়নি।
একটি পোস্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, জুলাই ঐক্য নামে একটি সংগঠন সেনানিবাসে আশ্রয় নেওয়া ৬২৬ জনের তালিকা প্রকাশের দাবি জানিয়েছে। সেনাবাহিনী এই বিষয়ে ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তালিকা জমা দিয়েছে এবং এটি মীমাংসিত বলে বিবেচিত হয়েছে। সেনাবাহিনী জনগণকে এই ধরনের দাবির বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে।
সেনাবাহিনীর অঙ্গীকার
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তার বিবৃতিতে জোর দিয়ে বলেছে, তারা পেশাদারিত্ব, নিষ্ঠা এবং জনগণের আস্থার সাথে দেশের পাশে থাকবে। তারা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অটল এবং যেকোনো সংকটে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেনাবাহিনী জনগণের কাছে আহ্বান জানিয়েছে, তারা যেন অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয় এবং সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থা বজায় রাখে।
উপসংহার
গণঅভ্যুত্থানের সময় সেনানিবাসে আশ্রয় প্রদানের বিষয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের অবস্থান স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। এই পদক্ষেপ ছিল মানবিক দায়বদ্ধতার অংশ এবং কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত হয়নি। সেনাবাহিনী জনগণকে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে তাদের পেশাদারিত্ব ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে।