অর্থনীতি

চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরে যুক্ত হচ্ছে আফগানিস্তান

চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (CPEC) এখন আফগানিস্তানকেও যুক্ত করার পথে এগোচ্ছে। এই করিডর যুক্ত হলে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার ভূরাজনৈতিক মানচিত্রে একটি বড় পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হবে। চীন, পাকিস্তান এবং তালেবান-শাসিত আফগানিস্তানের মধ্যে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে এ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে তিন দেশ।

বুধবার (২১ মে) চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয় এই বৈঠক, যেখানে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার এবং আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি অংশ নেন। বৈঠকে মূল আলোচ্য ছিল আঞ্চলিক নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ বিরোধী সহযোগিতা এবং অর্থনৈতিক সংযুক্তি।

CPEC প্রকল্প কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ?

চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (CPEC) হলো একাধিক অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, রেলপথ, শিল্প এলাকা ও বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের সমন্বিত রূপ। এটি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) বা ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ প্রকল্পের অন্যতম প্রধান উপাদান। CPEC-এর মাধ্যমে চীনের শিনজিয়াং প্রদেশ থেকে পাকিস্তানের গাওয়াদার বন্দর পর্যন্ত একটি অর্থনৈতিক করিডর গড়ে তোলা হচ্ছে, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার।

এই করিডরের মাধ্যমে চীন সহজে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় বাণিজ্য করতে পারবে, এবং পাকিস্তানের অবকাঠামো খাতে বিপুল বিনিয়োগ আসছে। এখন আফগানিস্তানকে যুক্ত করা হলে এই করিডরের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।

আফগানিস্তান CPEC-এ যুক্ত হলে কী লাভ?

বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানকে CPEC-এ যুক্ত করা হলে দেশটি ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় সুবিধা পাবে। একইসঙ্গে চীন তার মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের জন্য একটি নতুন প্রবেশপথ পেয়ে যাবে।

তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি বলেন, “আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতা জোরদারে আফগানিস্তান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”

চীনের পক্ষ থেকেও আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়।

রাজনৈতিক স্বীকৃতির অভাব, তবুও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার

২০২১ সালে তালেবানরা আফগানিস্তানের ক্ষমতা পুনরায় গ্রহণের পর এখনও পর্যন্ত চীন কিংবা পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে এই দুই দেশ ধীরে ধীরে তালেবান সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলছে।

চীন ইতোমধ্যেই কাবুলে একজন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেছে এবং বেশ কয়েকটি চীনা কোম্পানি আফগানিস্তানে খনিজ ও অবকাঠামো প্রকল্পে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। পাকিস্তানও তালেবান সরকারের সঙ্গে সীমান্ত নিরাপত্তা ও বাণিজ্যিক বিষয়ে কয়েকটি দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা করেছে।

সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতায় জোর

ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে তিন দেশই সন্ত্রাসবাদ ও বহিরাগত হুমকি মোকাবিলায় যৌথভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিশেষ করে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনা এবং সীমান্তে সহিংস ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তা ইস্যু ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, “সন্ত্রাসবাদ দমন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতা আরও জোরদার করার বিষয়ে তিন দেশ একমত হয়েছে।”

ভারতের প্রতিক্রিয়া ও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি

ভারতের পক্ষ থেকে এখনও আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া আসেনি, তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীন-পাকিস্তান-আফগানিস্তান অর্থনৈতিক জোট গঠনের এই উদ্যোগ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের কৌশলগত প্রভাবের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিতে পারে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে CPEC-কে তার সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে একটি প্রকল্প হিসেবে দেখে আসছে, কারণ এটি পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর দিয়ে অতিক্রম করে।

ভারতের কূটনীতিকদের মতে, চীন এই প্রকল্পের মাধ্যমে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ায় তাদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে এবং তা ভারতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

CPEC-এ আফগানিস্তানকে যুক্ত করা যেমন আঞ্চলিক বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত খুলবে, তেমনি এটি রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত দিক থেকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও বয়ে আনবে। তালেবান সরকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না থাকা, আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সমস্যা এবং সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানের সাথে টানাপোড়েন—এই তিনটি বিষয় প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

তবে চীন যদি কৌশলগতভাবে এই উদ্যোগ এগিয়ে নেয়, তাহলে এটি মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়ার মধ্যে একটি কার্যকর যোগাযোগ ও বাণিজ্যিক করিডরে পরিণত হতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button