বিশ্ব

ইংল্যান্ডে শুরু হচ্ছে বিশ্বের প্রথম গনোরিয়া টিকাদান

ইংল্যান্ডে যৌনবাহিত রোগ গনোরিয়ার বিরুদ্ধে বিশ্বের প্রথম টিকাদান কর্মসূচি শুরু হতে যাচ্ছে, যা যৌনস্বাস্থ্য খাতে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে ইংল্যান্ডের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা কর্তৃপক্ষ (এনএইচএস) গনোরিয়ার সংক্রমণ হ্রাস এবং অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের লক্ষ্য নিয়েছে। তবে, প্রাথমিকভাবে এই টিকা সবার জন্য উন্মুক্ত হবে না; মূলত সমকামী ও উভকামী পুরুষদের মধ্যে যাঁদের একাধিক যৌনসঙ্গী রয়েছে বা যৌনরোগের ইতিহাস রয়েছে, তাঁরা এই টিকার প্রাথমিক লক্ষ্য।

গনোরিয়া: সংক্রমণের হার ও উদ্বেগ

গনোরিয়া, নাইসেরিয়া গনোরিয়া নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট একটি যৌনবাহিত রোগ, যা যৌনাঙ্গ, মুখ এবং পায়ুগহ্বরে সংক্রমণ ছড়ায়। ২০২৩ সালে ইংল্যান্ডে ৮৫,০০০-এর বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, যা ১৯১৮ সাল থেকে রেকর্ডকৃত বার্ষিক সংক্রমণের সর্বোচ্চ হার। এই রোগের উপসর্গ সবসময় প্রকাশ পায় না, তবে ব্যথা, অস্বাভাবিক স্রাব, যৌনাঙ্গে প্রদাহ এবং বন্ধ্যত্বের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে ১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সী সমকামী ও উভকামী পুরুষ এবং আফ্রিকা ও ক্যারিবীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তিরা এই রোগে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন।

গনোরিয়ার চিকিৎসা ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে কারণ এই রোগের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তুলছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ভবিষ্যতে গনোরিয়া নিরাময়-অযোগ্য রোগে পরিণত হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে, সংক্রমণ প্রতিরোধই এই রোগ মোকাবিলার সর্বোত্তম উপায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

টিকাদান কর্মসূচির বিবরণ

ইংল্যান্ডে গনোরিয়ার টিকাদান কর্মসূচি আগামী আগস্ট ২০২৫ থেকে শুরু হবে। এই টিকা যৌনস্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে প্রদান করা হবে। টিকাটি মূলত মেনিনজাইটিস-বি প্রতিরোধে ব্যবহৃত ৪সিএমেনবি টিকা, যা শিশুদের জন্য ব্যবহৃত হয়। গনোরিয়া ও মেনিনজাইটিস-বি সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় এই টিকা গনোরিয়ার সংক্রমণ প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমাতে সক্ষম। যদিও এই কার্যকরতার হার তুলনামূলকভাবে কম, তবু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন এটি গনোরিয়ার বিস্তার রোধে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে।

এনএইচএস ইংল্যান্ডের প্রাথমিক ও কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা পরিচালক ড. আমান্ডা ডয়েল বলেন, “গনোরিয়ার বিরুদ্ধে বিশ্বের প্রথম নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি যৌনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় অগ্রগতি। এটি সংক্রমণের বিস্তার রোধ এবং অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী স্ট্রেনের বৃদ্ধি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।” তিনি আরও বলেন, এই উদ্যোগ ব্যক্তিদের সুরক্ষায় এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উপর চাপ কমাতে সহায়ক হবে।

টিকার কার্যকরতা ও চ্যালেঞ্জ

গনোরিয়ার টিকা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কার্যকর হলেও এটি সংক্রমণ পুরোপুরি প্রতিরোধ করতে পারে না। যৌথ টিকাকরণ ও টিকাদান কমিটির (জেসিভিআই) চেয়ারম্যান অধ্যাপক অ্যান্ড্রু পোলার্ড বলেন, “এই টিকা মাত্র ৩০ শতাংশ কার্যকর হলেও এটি গ্রহণ করা বুদ্ধিমানের কাজ। এটি সামগ্রিকভাবে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।” তিনি জানান, এই টিকা গনোরিয়ার সংক্রমণ কমাতে এবং অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার রোধে সহায়ক হবে।

টিকার সুরক্ষা কতদিন স্থায়ী হবে বা কতবার বুস্টার ডোজ নিতে হবে, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এছাড়া, যেহেতু এটি গনোরিয়ার জন্য বিশেষভাবে তৈরি টিকা নয়, তাই রোগীদের সঙ্গে সংবেদনশীলভাবে আলোচনা করে তাঁদের সঠিক প্রত্যাশা নির্ধারণ করতে হবে। যৌনস্বাস্থ্য ক্লিনিকগুলোতে এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কনডমের ব্যবহারকে উৎসাহিত করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত প্রভাব

ইম্পিরিয়াল কলেজ লন্ডনের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এই টিকা জনপ্রিয় হলে আগামী এক দশকে ১ লাখ গনোরিয়া সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে, যা এনএইচএসের প্রায় ৮০ লাখ পাউন্ড সাশ্রয় করতে পারে। টিকার প্রতি ডোজের মূল্য প্রায় ৮ পাউন্ড, এবং প্রাথমিকভাবে সমকামী ও উভকামী পুরুষদের টিকা দেওয়া সাশ্রয়ী ও কার্যকর বলে বিবেচিত হচ্ছে। তবে চিকিৎসকদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যাতে উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা অন্যান্য ব্যক্তিরাও এই টিকা পেতে পারেন।

এই কর্মসূচির আওতায় এমপক্স, এইচপিভি এবং হেপাটাইটিসের টিকাও দেওয়া হবে, যা যৌনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাড়তি সুবিধা প্রদান করবে। ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর সেক্সুয়াল হেলথ অ্যান্ড এইচআইভির সভাপতি অধ্যাপক ম্যাট ফিলিপস বলেন, “এটি যৌনস্বাস্থ্যের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। গনোরিয়ার রোগনির্ণয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, এবং এই টিকা এই প্রবণতা পাল্টাতে সহায়ক হবে।”

সমালোচনা ও প্রশংসা

যুক্তরাজ্যের জয়েন্ট কমিটি অন ভ্যাকসিনেশন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (জেসিভিআই) এই টিকাদান কর্মসূচির সুপারিশ করার প্রায় দেড় বছর পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই দীর্ঘ অপেক্ষার জন্য যৌনস্বাস্থ্য সংস্থাগুলো সমালোচনা করেছে, তবে তারা এই উদ্যোগকে একটি বড় বিজয় হিসেবে স্বাগত জানিয়েছে। টেরেন্স হিগিন্স ট্রাস্টের নীতি ও অ্যাডভোকেসি প্রধান কেটি ক্লার্ক বলেন, “এটি একটি বিশাল জয়। এই টিকা গনোরিয়ার বিস্তার কমাতে এবং যৌনস্বাস্থ্য সেবার উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।”

স্কটল্যান্ডের পরিকল্পনা

ইংল্যান্ডের পাশাপাশি স্কটল্যান্ডের স্বাস্থ্যসেবা কর্তৃপক্ষ পাবলিক হেলথ স্কটল্যান্ডও উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য একটি টিকাদান কর্মসূচি শুরু করার পরিকল্পনা করছে। এটি যৌনবাহিত রোগ প্রতিরোধে যুক্তরাজ্যের সমন্বিত প্রচেষ্টার একটি অংশ।

সামাজিক সচেতনতা ও প্রতিরোধ

যৌনস্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারক ম্যাক্স, যিনি এক বছরে দুবার গনোরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন, এই টিকাকে একটি গেম-চেঞ্জার হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, “এটি ক্লিনিকগুলোর উপর চাপ কমাবে এবং সামগ্রিকভাবে যৌনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে।” তিনি জানান, তিনি শতভাগ এই টিকা গ্রহণ করবেন।

গনোরিয়া প্রতিরোধে কনডমের ব্যবহার এবং নিয়মিত পরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইউকে হেলথ সিকিউরিটি এজেন্সি (ইউকেএইচএসএ) নতুন বা নৈমিত্তিক যৌনসঙ্গীদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কনডম ব্যবহার এবং নিয়মিত পরীক্ষার পরামর্শ দিয়েছে। এই টিকাদান কর্মসূচির সঙ্গে এই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলো সমন্বিতভাবে গনোরিয়ার বিস্তার কমাতে সহায়ক হবে।

উপসংহার

ইংল্যান্ডের গনোরিয়া টিকাদান কর্মসূচি যৌনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। যদিও টিকাটির কার্যকরতা সীমিত, তবু এটি সংক্রমণ হ্রাস এবং অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই উদ্যোগ যৌনস্বাস্থ্য সেবার উন্নতি, স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় হ্রাস এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button