তেলের দাম লিটারে ৩৫ টাকা বাড়ালো টিসিবি

ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ঈদুল আযহার আগে ভোজ্য তেল, মসুর ডাল এবং চিনির দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়েছে। এক মাসের ব্যবধানে প্রতি লিটার তেলের দাম ৩৫ টাকা, প্রতি কেজি মসুর ডালের দাম ২০ টাকা এবং চিনির দাম ১৫ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই দাম বৃদ্ধির ফলে নিম্নআয়ের পরিবারগুলোর উপর অতিরিক্ত আর্থিক চাপ পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বুধবার টিসিবি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে। বৃহস্পতিবার (২২ মে) থেকে সারা দেশে ফ্যামিলি কার্ডধারী নিম্নআয়ের পরিবারের মধ্যে ভর্তুকিমূল্যে পণ্য বিক্রি শুরু করবে সংস্থাটি।
দাম বৃদ্ধির বিস্তারিত
টিসিবির বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, নতুন মূল্য নির্ধারণে ভোজ্য তেলের দাম প্রতি লিটার ১০০ টাকা থেকে বেড়ে ১৩৫ টাকা, মসুর ডালের দাম প্রতি কেজি ৬০ টাকা থেকে ৮০ টাকা এবং চিনির দাম প্রতি কেজি ৭০ টাকা থেকে ৮৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই দাম বৃদ্ধি ফ্যামিলি কার্ডধারীদের জন্য প্রযোজ্য হলেও সাধারণ ভোক্তারাও টিসিবির ভ্রাম্যমাণ ট্রাক থেকে এই পণ্য কিনতে পারবেন। তবে, সাধারণ ভোক্তাদের ক্ষেত্রেও বাড়তি দাম গুনতে হবে।
টিসিবি জানিয়েছে, দেশব্যাপী প্রতিদিন ৬৯০টি ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে এই পণ্য বিক্রি করা হবে। ঢাকায় ৫০টি, চট্টগ্রামে ২০টি, ছয়টি বিভাগীয় শহরে ১০টি করে এবং অবশিষ্ট ৫৬টি জেলা শহরে ১০টি করে ট্রাক নিয়োজিত থাকবে। এই বিক্রয় কার্যক্রম ২২ মে থেকে শুরু হয়ে আগামী ৩ জুন পর্যন্ত চলবে, যার মধ্যে শুক্রবার এবং ছুটির দিনগুলোও অন্তর্ভুক্ত।
কেন দাম বাড়লো?
টিসিবির দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের পেছনে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেল, ডাল এবং চিনির মূল্যবৃদ্ধি এবং স্থানীয় সরবরাহ ব্যবস্থার ব্যয় বৃদ্ধিকে দায়ী করা হচ্ছে। তবে, টিসিবির বিজ্ঞপ্তিতে এই দাম বৃদ্ধির নির্দিষ্ট কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি এবং মুদ্রার বিনিময় হারের ওঠানামা এই সিদ্ধান্তের পেছনে প্রধান কারণ হতে পারে।
নিম্নআয়ের পরিবারগুলোর জন্য ভর্তুকিমূল্যে পণ্য সরবরাহের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে টিসিবি। তবে, এই দাম বৃদ্ধির ফলে ভর্তুকির পরিমাণ কমে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে, ঈদুল আযহার মতো উৎসবের সময়ে এই দাম বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জন্য অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
নিম্নআয়ের পরিবারের উপর প্রভাব
টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডধারী পরিবারগুলো সাধারণত নিম্নআয়ের শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এই পরিবারগুলো টিসিবির ভর্তুকিমূল্যের পণ্যের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। দাম বৃদ্ধির ফলে তাদের মাসিক বাজেটে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়বে। উদাহরণস্বরূপ, একটি পরিবার যদি মাসে দুই লিটার তেল, দুই কেজি মসুর ডাল এবং এক কেজি চিনি ক্রয় করে, তবে তাদের অতিরিক্ত খরচ হবে (৩৫×২ + ২০×২ + ১৫×১) = ১২৫ টাকা। এই পরিমাণ অর্থ নিম্নআয়ের পরিবারের জন্য উল্লেখযোগ্য।
ঢাকার বাসিন্দা মো. রফিকুল ইসলাম, যিনি একজন ফ্যামিলি কার্ডধারী, বলেন, “ঈদের আগে এই দাম বৃদ্ধি আমাদের জন্য বড় ধাক্কা। আমরা টিসিবির পণ্যের উপর নির্ভর করি কারণ এটা সাশ্রয়ী। কিন্তু এখন দাম বাড়ায় আমাদের বাজেটে টান পড়বে।” অনেকে মনে করছেন, টিসিবির এই সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়িয়ে তুলবে।
সাধারণ ভোক্তাদের জন্য সুযোগ
টিসিবি জানিয়েছে, ফ্যামিলি কার্ডধারীদের পাশাপাশি সাধারণ ভোক্তারাও ভ্রাম্যমাণ ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে পারবেন। এই উদ্যোগ ঈদুল আযহার সময়ে পণ্যের চাহিদা মেটাতে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে, সাধারণ ভোক্তাদের ক্ষেত্রে দামের কোনো ভর্তুকি না থাকায় তারা বাজারমূল্যের কাছাকাছি দামে পণ্য কিনতে বাধ্য হবেন। এটি সাধারণ ভোক্তাদের জন্য টিসিবির পণ্য ক্রয়ের আকর্ষণ কিছুটা কমিয়ে দিতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতামত
অর্থনীতিবিদ এবং বাজার বিশ্লেষকরা টিসিবির এই দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। কেউ কেউ মনে করছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির কারণে টিসিবির এই সিদ্ধান্ত অনিবার্য ছিল। তবে, অনেকে এই সময়ে দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে সমালোচনা করে বলেছেন, ঈদের মতো উৎসবের সময়ে এই ধরনের সিদ্ধান্ত জনগণের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক বলেন, “টিসিবির মূল লক্ষ্য হচ্ছে নিম্নআয়ের মানুষের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য সরবরাহ করা। দাম বৃদ্ধির ফলে এই লক্ষ্য কিছুটা বিঘ্নিত হতে পারে। সরকারের উচিত ভর্তুকির পরিমাণ বাড়িয়ে জনগণের উপর চাপ কমানো।”
ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের কার্যক্রম
টিসিবির ভ্রাম্যমাণ ট্রাক কার্যক্রমটি সারা দেশে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। প্রতিদিন ৬৯০টি ট্রাকের মাধ্যমে পণ্য বিক্রির এই উদ্যোগ গ্রামীণ ও শহুরে উভয় এলাকার মানুষের কাছে পণ্য পৌঁছে দিচ্ছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোতে ট্রাকের সংখ্যা বেশি থাকলেও জেলা পর্যায়ে সীমিত সংখ্যক ট্রাকের কারণে অনেক এলাকায় পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
টিসিবি জানিয়েছে, প্রতিটি ট্রাকে ভোজ্য তেল, মসুর ডাল এবং চিনি পাওয়া যাবে। তবে, পণ্যের পরিমাণ এবং সরবরাহের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা সংস্থাটির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। বিশেষ করে, ঈদের সময়ে চাহিদা বৃদ্ধির কারণে ট্রাকগুলোর উপর চাপ বাড়তে পারে।
সরকারের ভূমিকা
টিসিবির এই দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সরকারের অর্থনৈতিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রতিশ্রুতি থাকলেও এই ধরনের সিদ্ধান্ত সেই প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন অনেকে। সরকারের উচিত ভর্তুকি বাড়িয়ে এবং সরবরাহ ব্যবস্থা জোরদার করে জনগণের উপর চাপ কমানো।
উপসংহার
টিসিবির দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত ঈদুল আযহার আগে নিম্নআয়ের পরিবার এবং সাধারণ ভোক্তাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ভোজ্য তেল, মসুর ডাল এবং চিনির মতো প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়িয়ে তুলবে। টিসিবির ভ্রাম্যমাণ ট্রাক কার্যক্রম পণ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করলেও দাম বৃদ্ধির প্রভাব কমাতে সরকারের পক্ষ থেকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন।