বিশ্ব

যুক্তরাজ্যের অর্ধেক তরুণ-তরুণী চায় ইন্টারনেটবিহীন জীবন

বর্তমান সময়ে ইন্টারনেট ছাড়া জীবন কল্পনাই করা কঠিন। তবে ব্রিটেনের তরুণ-তরুণীদের একটি বড় অংশ এখন সেই অসম্ভব কল্পনাকেই বাস্তব হিসেবে দেখতে চাইছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যের অর্ধেকের বেশি তরুণ-তরুণী ইন্টারনেটবিহীন পৃথিবীতে বাস করতে চান। প্রযুক্তি নির্ভর জীবনের নেতিবাচক প্রভাব এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা এ চাওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

জরিপে চমকপ্রদ তথ্য

যুক্তরাজ্যের ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ডস ইনস্টিটিউট (BSI) পরিচালিত এক জরিপে ১৬ থেকে ২১ বছর বয়সী ১,২৯৩ জন তরুণ-তরুণী অংশগ্রহণ করেন। এই জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ ইন্টারনেট ছাড়া জীবনযাপন করতে আগ্রহী বলে জানান। প্রায় ৭০ শতাংশ তরুণ জানিয়েছেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় দীর্ঘ সময় কাটানোর পর তারা নিজেদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন।

অর্ধেক তরুণ মত দিয়েছেন তথাকথিত ‘ডিজিটাল কারফিউ’র পক্ষে। তারা চান, রাত ১০টার পর নির্দিষ্ট কিছু অ্যাপ বা ওয়েবসাইটে প্রবেশে প্রযুক্তিগতভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হোক, যেমন ইনস্টাগ্রাম ও টিকটক।

সোশ্যাল মিডিয়ায় চার ঘণ্টার বেশি কাটান ২৫ শতাংশ

জরিপে দেখা গেছে, তরুণদের এক-চতুর্থাংশ প্রতিদিন চার ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটান। এই দীর্ঘ সময় অনলাইনে কাটানোর ফলে মানসিক অবসাদ, আত্মমূল্যায়নের ঘাটতি, উদ্বেগ, এবং আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়ার মতো সমস্যা বাড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

অংশগ্রহণকারীদের ৪২ শতাংশ স্বীকার করেছেন, তারা তাঁদের অভিভাবকদের কাছে অনলাইনে কী করেন তা নিয়ে মিথ্যা বলেন। আবার সমান সংখ্যক তরুণ জানিয়েছেন, তারা বয়স নিয়ে অনলাইনে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন।

এছাড়াও ৪০ শতাংশের ‘বার্নার’ বা বিকল্প অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যা দিয়ে তারা ভিন্ন পরিচয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় থাকেন। এমনকি ২৭ শতাংশ তরুণ সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিচয়ে নিজেদের উপস্থাপন করেন।

অবস্থান শেয়ার ও অপরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ

অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ আরেকটি তথ্য হলো, ২৭ শতাংশ তরুণ ইন্টারনেটে অপরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে তাদের অবস্থান শেয়ার করেছেন। এটি অনলাইন হয়রানি, প্রতারণা বা নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকির দরজা খুলে দিতে পারে।

করোনার সময় অনলাইন আসক্তি বেড়ে যায়

জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৭৫ শতাংশ স্বীকার করেছেন, করোনা মহামারির সময় তাদের অনলাইনে সময় কাটানোর পরিমাণ বেড়ে যায়। এর প্রভাবও সুস্পষ্ট—৬৮ শতাংশ মনে করেন, এই অতিরিক্ত অনলাইন সময় তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে

সরকার ও সংস্থাগুলোর প্রতিক্রিয়া

জরিপের ফলাফল সামনে আসার পর যুক্তরাজ্যের প্রযুক্তিবিষয়ক সচিব পিটার কাইল জানিয়েছেন, সরকার কিছু জনপ্রিয় অ্যাপ যেমন টিকটক ও ইনস্টাগ্রামের ব্যবহারে নির্দিষ্ট সময় পর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে।

তবে অনলাইন শিশু নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংস্থা NSPCC-এর নীতিনির্ধারক রানি গোভিন্দর এক ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “শুধু ডিজিটাল কারফিউ দিয়ে শিশুদের অনলাইন ঝুঁকি থেকে পুরোপুরি রক্ষা করা সম্ভব নয়। দিনের অন্যান্য সময়েও তারা ক্ষতিকর কনটেন্টের মুখোমুখি হতে পারে।”

তিনি জোর দিয়ে বলেন, সরকার ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত একটি নিরাপদ, কম আসক্তিকর এবং শিশুদের উপযোগী অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা

অ্যালগরিদম নিয়ে উদ্বেগ

আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাজ করা দাতব্য সংস্থা মলি রোজ ফাউন্ডেশন-এর প্রধান নির্বাহী অ্যান্ডি বারো বলেন, “তরুণেরা অনলাইনের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন এবং তারা কার্যকর পদক্ষেপ চায় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে।”

তিনি আরও বলেন, “অ্যালগরিদমের মাধ্যমে তরুণদের সামনে এমন সব কনটেন্ট উপস্থাপন করা হয়, যা তাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে এবং দ্রুত নেতিবাচক অবস্থার দিকে ঠেলে দেয়।”

অ্যান্ডি বারো মনে করেন, এই সমস্যা সমাধানে বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বাণিজ্যিক স্বার্থ নয় বরং সমাজ ও শিশুদের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়ে নতুন আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন

এই জরিপের ফলাফল ব্রিটেনের তরুণ প্রজন্মের মনের ভেতরে জমে থাকা অস্বস্তি, অবসাদ ও উদ্বেগের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যতটা না বিনোদনের মাধ্যম, তার চেয়ে অনেক বেশি হয়ে উঠছে মানসিক চাপ ও আত্মমূল্যহীনতার উৎস। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা শুধু যুক্তরাজ্যের তরুণদের সমস্যা নয়—বিশ্বজুড়ে ডিজিটাল প্রজন্মের এক ভয়াবহ সংকেত।

সার্বিকভাবে বিষয়টি নিয়ে সতর্ক দৃষ্টি, কার্যকর নীতি এবং প্রযুক্তিনির্ভর সমস্যার জন্য প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান দরকার। অনলাইন জগতকে তরুণদের জন্য নিরাপদ, ইতিবাচক ও স্বাস্থ্যকর রাখতে হলে এখনই উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button