প্রথমবারের মতো চীন যাচ্ছে বাংলাদেশি আম

বাংলাদেশের কৃষি পণ্য রপ্তানির ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে। প্রথমবারের মতো চীনে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশি আম। আগামী ২৮ মে থেকে শুরু হবে এই রপ্তানি কার্যক্রম—এমনটাই জানিয়েছেন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান ও অতিরিক্ত সচিব আনোয়ার হোসেন। তিনি আরও জানান, চলতি আম মৌসুমে চীন বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন আম আমদানির আগ্রহ দেখিয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় মঙ্গলবার (২০ মে) দুপুরে এসব তথ্য দেন তিনি। সভায় উপস্থিত ছিলেন দেশের শীর্ষ আম রপ্তানিকারক, স্থানীয় উদ্যোক্তা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা।
চীনের বাজারে বাংলাদেশের প্রথম পদচারণা
এই রপ্তানি কার্যক্রম শুধু অর্থনীতিক নয়, কূটনৈতিক ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতির ক্ষেত্রেও এক বড় অর্জন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইতোমধ্যে চীনের রাষ্ট্রদূত, প্রতিনিধি দল এবং বায়াররা চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন আমবাগান পরিদর্শন করেছেন এবং বাংলাদেশের আমের মানে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
এই সফরের পরই রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনকারী কৃষক ও রপ্তানিকারকদের একটি তালিকা চীনা দূতাবাসে পাঠানো হয়েছে। সেখানে স্যানিটারি ও ফাইটো-স্যানিটারি স্ট্যান্ডার্ড নিশ্চিত হওয়ার পর, পর্যায়ক্রমে চীনা কোম্পানিগুলো চাষিদের কাছ থেকে আম কিনবে।
চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর প্রস্তুতি
সভায় আনোয়ার হোসেন জানান, আম রপ্তানিকে টেকসই এবং লাভজনক করতে পরিবহন, কার্গো ফ্যাসিলিটিজ, হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট এবং কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। রপ্তানির ক্ষেত্রে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেগুলোর সমাধানে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য আগামী তিন বছরের মধ্যে ৩ থেকে ৫ লাখ মেট্রিক টন আম চীনসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা। এজন্য কৃষকদের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রশিক্ষণ, গ্লোবাল সার্টিফিকেশন অর্জন এবং বিশ্বমানের উৎপাদনে আগ্রহী হতে হবে।”
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি আমের সম্ভাবনা
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চীনসহ বড় আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের আম প্রবেশের মাধ্যমে এই খাতে বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে আমের চাহিদা বাড়ছে, বিশেষ করে নিরাপদ ও রাসায়নিকমুক্ত ফলের চাহিদা বেশি। বাংলাদেশের আম স্বাদ, ঘ্রাণ এবং প্রাকৃতিক উৎপাদনের জন্য ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে পরিচিতি পেয়েছে। এবার তা বাণিজ্যিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দিকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সভায় এ প্রসঙ্গে বক্তব্য রাখেন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিচালক মো. শাহজালাল, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ইকতেখারুল ইসলাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুনজের আলম মানিক, রপ্তানিকারক ইসমাঈল খান শামীম ও আহসান হাবীব।
ঢাকায় আয়োজন হবে কূটনৈতিক আম প্রদর্শনী
দেশি ও বিদেশি বাজারে বাংলাদেশের আমকে পরিচিত করার লক্ষ্যে আগামী জুন মাসে ঢাকায় একটি কূটনৈতিক আম প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে। এই আয়োজনে কূটনীতিক, আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী প্রতিনিধি এবং দেশীয় উদ্যোক্তাদের একত্রিত করা হবে।
আয়োজকরা আশা করছেন, এই আয়োজন বিদেশি ক্রেতাদের আরও উৎসাহিত করবে এবং আম রপ্তানিতে নতুন দরজা খুলে দেবে।
প্রক্রিয়াজাত আম পণ্য: ভবিষ্যতের বড় বাজার
সভায় আরও আলোচনায় উঠে আসে আম থেকে তৈরি বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত পণ্যের সম্ভাবনার কথা। যেমন: আমের জ্যাম, জেলি, জুস, আমচূর্ণ প্রভৃতি। এসব পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে বিশাল চাহিদা রয়েছে। ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, “শুধু কাঁচা আম নয়, আমাদের উদ্যোক্তারা যদি আম ভিত্তিক প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বিনিয়োগ করেন, তবে দেশে এবং বিদেশে এর বড় বাজার সৃষ্টি হবে।”
রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনে মাঠ পর্যায়ের তৎপরতা
সভা শেষে ভাইস চেয়ারম্যান শিবগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্প পরিদর্শন করেন। সেখানে তিনি কৃষকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া সরেজমিনে দেখেন। তিনি বলেন, “ভবিষ্যতে এই উৎপাদন আরও বাণিজ্যিকভাবে সম্প্রসারিত করতে হবে এবং তা নির্ভরযোগ্য ও মানসম্মত হতে হবে।”
উপসংহার
বাংলাদেশের আম রপ্তানির এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে দেশের কৃষি অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলবে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে এবং কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। তবে এ যাত্রা সহজ হবে না। এর জন্য দরকার সমন্বিত উদ্যোগ, সরকারি সহযোগিতা এবং আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি।
সরকার ও বেসরকারি খাতের যৌথ প্রচেষ্টায় যদি এই রপ্তানি কার্যক্রম সফল হয়, তাহলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই আম হতে পারে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য।