বিশ্ব

৭ মাসে ২৫ জনের সঙ্গে বিয়ে ও লুটপাটের অভিযোগে ভারতে নারী গ্রেফতার

ভারতের রাজস্থান রাজ্যে সম্প্রতি এক নজিরবিহীন প্রতারণা মামলার ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল অর্থ ও সম্পদ লুটপাট—এমনটাই অভিযোগ উঠেছে ২৩ বছর বয়সী এক নারীর বিরুদ্ধে, যিনি মাত্র সাত মাসে ২৫ জন পুরুষকে বিবাহ করেছিলেন। তার আসল নাম অনুরাধা পাসওয়ান। সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশের ভোপাল শহর থেকে তাকে গ্রেফতার করেছে রাজস্থান পুলিশ। এই নারীকে স্থানীয় গণমাধ্যমে আখ্যা দেওয়া হয়েছে ‘লুট বধূ’ হিসেবে।

বিয়ের নামে প্রতারণার চক্র

অনুরাধা পাসওয়ান শুধু এককভাবে এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, বরং তিনি একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য বলেই অভিযোগ করেছে পুলিশ। এই চক্রটি বিশেষভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করত রাজস্থান ও আশেপাশের রাজ্যগুলোতে। তারা মূলত সামাজিকভাবে বা বয়সগত কারণে বিয়ে করতে ব্যাকুল পুরুষদের টার্গেট করত। স্থানীয় এজেন্টদের মাধ্যমে গরিব ও একাকী পুরুষদের খুঁজে বের করে তাদের কাছে নববধূর প্রস্তাব দেওয়া হতো।

চক্রটির পদ্ধতি ছিল সুপরিকল্পিত। হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বিভিন্ন নারীর ছবি দেখিয়ে এজেন্টরা পাত্রের কাছ থেকে ২ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দাবি করত। এরপর বিচারালয়ে কোর্ট ম্যারেজের মাধ্যমে বৈধভাবে বিয়ে সম্পন্ন করত অনুরাধা। কিছুদিন স্বামীর সঙ্গে ঘর সংসার করে, সুযোগ বুঝে নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী নিয়ে পালিয়ে যেতেন তিনি।


ধরা পড়ার পেছনের ঘটনা

এই প্রতারণার শিকার প্রথম ব্যক্তি হলেন রাজস্থানের সাওয়াই মাধোপুর জেলার বাসিন্দা বিষ্ণু শর্মা। তিনি পুলিশকে জানান, অনুরাধার সঙ্গে তার বিয়ে হয় ২০২৫ সালের ২০ এপ্রিল, এজেন্ট সুনিতা ও পাপ্পু মীনার মাধ্যমে। তিনি দুই লাখ টাকা এজেন্টদের দিয়েছিলেন কনের খোঁজ পাওয়ার জন্য। কিন্তু বিয়ের মাত্র ১২ দিন পর, ২ মে রাতে, অনুরাধা তার বাসা থেকে নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার এবং বেশ কিছু মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে পালিয়ে যান।

এই অভিযোগের ভিত্তিতে রাজস্থান পুলিশ শুরু করে একটি গোপন অভিযান। পুলিশের একজন সদস্যকে ‘পাত্র’ সাজিয়ে পাঠানো হয় চক্রের এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। এজেন্টরা যখন অনুরাধার ছবি ও বিবরণ পাঠায়, তখন প্রযুক্তির সাহায্যে ফোনের লোকেশন ট্র্যাক করে তাকে মধ্যপ্রদেশের ভোপাল থেকে গ্রেফতার করা হয়।

চক্রের কার্যপ্রণালী ও বিস্তার

অনুরাধা পাসওয়ান এই প্রতারণার মাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রায় ২৫ জন পুরুষকে ঠকিয়েছেন বলে পুলিশের দাবি। প্রতিটি ঘটনায় একই কৌশল অবলম্বন করা হতো। প্রথমে একটি নির্দিষ্ট স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করা হতো। এরপর খুব দ্রুত কোর্ট ম্যারেজ করে কনের পক্ষ থেকে দাবি করা হতো যৌতুক বা অর্থ সহায়তা। বিয়ের পর, একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাড়ি থেকে সমস্ত সম্পদ নিয়ে তিনি চম্পট দিতেন।

পুলিশ বলছে, এই ধরনের প্রতারণা চক্র শুধু অনুরাধাকেই কেন্দ্র করে নয়, এর পেছনে একটি সুসংগঠিত গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। গ্যাংয়ের সদস্যরা রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে ছড়িয়ে রয়েছে। তাদের একাধিক এজেন্ট সামাজিক মাধ্যমে বা স্থানীয়ভাবে পাত্র খুঁজে বের করে।

আইনি প্রক্রিয়া ও তদন্তের অগ্রগতি

রাজস্থান পুলিশ জানিয়েছে, অনুরাধার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে একাধিক মামলা দায়ের হয়েছে। প্রতিটি ঘটনায় প্রতারণা, বিশ্বাসভঙ্গ এবং অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে। পুলিশ এখন ওই চক্রের অন্যান্য সদস্যদের ধরতে অনুসন্ধান চালাচ্ছে এবং সম্ভাব্য আরও ভুক্তভোগীদের খোঁজ নিচ্ছে।

এছাড়াও তদন্তকারীরা খতিয়ে দেখছেন, অভিযুক্ত নারী ও তার দলের সদস্যরা কীভাবে ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে বিভিন্ন স্থানে কোর্ট ম্যারেজ সম্পন্ন করেছেন। তারা বিভিন্ন নাম ও ঠিকানায় নিবন্ধন করে যাতে কোনো সন্দেহ না হয় এবং তদন্তকারীদের বিভ্রান্ত করা যায়।

ভবিষ্যতের জন্য সতর্কবার্তা

এমন প্রতারণার ঘটনা ভারতের সমাজে নতুন নয়, তবে এ ধরনের সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের ঘটনা এখন আরও ঘনঘন ঘটছে। বিশেষ করে অনলাইন মাধ্যমে বিয়ের প্রস্তাবের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রতারণার সুযোগও বাড়ছে। পুলিশের পক্ষ থেকে সাধারণ জনগণকে সতর্ক থাকতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যেন তারা সন্দেহজনক ব্যক্তিদের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন বা সম্পর্ক স্থাপন থেকে বিরত থাকেন।

বিশেষ করে, যারা বিয়ের মাধ্যমে জীবনসঙ্গী খুঁজছেন, তাদের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম ব্যবহার করার আহ্বান জানানো হয়েছে। কোর্ট ম্যারেজ হলেও সঠিক পরিচয়পত্র যাচাই, পারিবারিক পটভূমি যাচাই, এবং আইনিভাবে বিবাহের সকল কাগজপত্র ঠিক আছে কিনা, তা নিশ্চিত করাই উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

উপসংহার

অনুরাধা পাসওয়ানের গ্রেফতারের মাধ্যমে এক জটিল প্রতারণা চক্রের কাহিনি সামনে এসেছে। তার কর্মকাণ্ড শুধু ব্যক্তিগতভাবে কিছু পুরুষের ক্ষতি করেনি, বরং এটি সামাজিক বিশ্বাস ও সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তদন্ত এখনও চলমান এবং পুলিশের দাবি অনুযায়ী, এই চক্রের অনেক সদস্য এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। রাজস্থান পুলিশ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এই চক্রকে সম্পূর্ণভাবে উৎখাত করতে তারা প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button