কালো টাকা সাদা করার সব বিধান বাতিলের দাবি টিআইবির

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) কালো টাকা সাদা করার সব ধরনের সুযোগ অবিলম্বে বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থাটি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছে, আয়কর আইন ২০২৩-এ বিদ্যমান বিধানগুলো অসাংবিধানিক, দুর্নীতিকে উৎসাহিতকারী এবং বৈষম্যমূলক। তাই এগুলোকে অনতিবিলম্বে অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাতিল করা উচিত।
মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫ তারিখে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে টিআইবি জানায়, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত ২১ বার বিভিন্ন সরকার কালো টাকা সাদা করার সুবিধা দিয়েছে। অথচ এই ধরনের সুবিধা রাজস্ব আয় বাড়াতে তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি, বরং নৈতিক ও সাংবিধানিক দিক থেকে তা একধরনের ক্ষতির কারণ হয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘এই ধরনের উদ্যোগ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করে, বৈধভাবে আয় করা ও কর প্রদানকারী নাগরিকদের প্রতি একধরনের অবিচার ও বৈষম্য সৃষ্টি করে। এর ফলে দুর্নীতিকে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করা হয়।’’
কালো টাকার বৈধতা: একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত
টিআইবির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বর্তমানে আয়কর আইন ২০২৩-এ তিনটি স্পষ্ট ধারা বা বিধান রয়ে গেছে, যা কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত আয়কে বৈধ করার পথ খুলে দেয়। এগুলোর মাধ্যমে কোনো জবাবদিহি বা প্রশ্ন ছাড়াই অপ্রদর্শিত আয় ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করে বৈধ করা যায়। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘এটি সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদের সরাসরি লঙ্ঘন। ওই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, দেশের প্রতিটি নাগরিকের আয়-উপার্জন অবশ্যই নৈতিক ও আইনসিদ্ধ পথে হতে হবে।’’
তিনি আরও বলেন, এই বিধানগুলোর মাধ্যমে দেশের দুর্নীতিবাজরা বারবার বৈধতার সুযোগ পাচ্ছেন। অথচ সাধারণ করদাতারা তাদের রুজির ওপর যথাযথ কর পরিশোধ করেও রাষ্ট্র থেকে পর্যাপ্ত সেবা পান না। এটি শুধুমাত্র আর্থিক বৈষম্য নয়, এটি সামাজিক অবিচার ও নৈতিক অবক্ষয়ের দৃষ্টান্ত।
অন্তর্বর্তী সরকারের করণীয়
ড. ইফতেখারুজ্জামান আশা প্রকাশ করেন, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের প্রথম বাজেটে একটি দৃষ্টান্তমূলক সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি বলেন, ‘‘কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করা হলে তা কেবল একটি আর্থিক সিদ্ধান্তই হবে না, এটি একটি শক্তিশালী নৈতিক অবস্থান হবে যা আগামী দিনের জন্য সঠিক বার্তা দেবে।’’
টিআইবি জানায়, ইতোমধ্যে সংস্থাটি অর্থ উপদেষ্টার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি চিঠি দিয়েছে, যেখানে এই বিধানগুলো বাতিলের জন্য জরুরি অধ্যাদেশ জারির আহ্বান জানানো হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের সুপারিশ ও বাস্তবতা
টিআইবি বলছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশন সুপারিশ করেছে, ‘‘যেকোনোভাবে বৈধ উৎস ছাড়া আয়ের বৈধতা দেওয়ার প্রক্রিয়া স্থায়ীভাবে বন্ধ করা উচিত।’’ কিন্তু এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘যদি আমরা সত্যিই দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে চাই, তবে আমাদের প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত কালো টাকার বৈধতার পথ চিরতরে বন্ধ করা।’’
তিনি অতীতের উদাহরণ দিয়ে বলেন, বহুবার এই ধরনের সুযোগ দেওয়া হলেও রাজস্ব আয়ে তেমন ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। বরং কর আদায়ের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়েছে, আর দুর্নীতিবাজদের মধ্যে ‘ধরা না পড়লে বৈধতা পাওয়া সম্ভব’—এই মনোভাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সংবিধানের দৃষ্টিকোণ থেকে কালো টাকা
বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের আয়-উপার্জন হতে হবে আইনের আওতায়, এবং রাষ্ট্রের প্রতি কর প্রদান একটি মৌলিক দায়িত্ব। সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘‘সকল প্রকার কাজ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য নৈতিক ও আইনি হওয়া আবশ্যক।’’ অথচ কালো টাকা বৈধ করার বিধান এই মৌলিক নীতির পরিপন্থী।
আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, অধ্যাদেশের মাধ্যমে এই বিধানগুলো বাতিল করা সংবিধান অনুযায়ী সম্পূর্ণ যুক্তিসংগত হবে। তারা আরও বলেন, এটি কেবল রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রশ্ন নয়, এটি দেশের নৈতিক ও আইনি কাঠামোর প্রতি শ্রদ্ধার বিষয়।
অতীতের ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি নয়
টিআইবি মনে করে, যেহেতু অতীতে এই ধরনের সুবিধা দিয়ে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় হয়নি এবং দুর্নীতির মাত্রা কমেনি, তাই একই ভুল পুনরায় করা যাবে না। বরং এখন সময় হয়েছে শক্ত অবস্থান নেওয়ার, যা দেশের আইনি কাঠামোকে শক্তিশালী করবে এবং জনগণের রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনবে।
সংস্থাটি মনে করে, অর্থনীতির বৈধীকরণ ও রাজস্ব আদায়ে দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে কর ব্যবস্থার সংস্কার, কর পরিশোধে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং কর ফাঁকি রোধে কার্যকর তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
উপসংহার
টিআইবির বক্তব্য স্পষ্ট—কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়া নৈতিকভাবে ভুল, আইনি কাঠামোর পরিপন্থী এবং এটি সাধারণ নাগরিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যদি সত্যিকারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চায়, তবে এই সুবিধাগুলোকে অবিলম্বে বাতিল করে একটি সুশাসনভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করতে হবে।