বিনোদন

নুসরাত ফারিয়ার গ্রেপ্তারে নীরব চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি, সরব অভিনয় শিল্পী সংঘ

চিত্রনায়িকা নুসরাত ফারিয়ার গ্রেপ্তারের ঘটনায় নীরব ভূমিকা পালন করছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি। অন্যদিকে অভিনয় শিল্পী সংঘ শিল্পীদের সম্মান রক্ষায় কড়া বিবৃতি দিয়েছে। বিষয়টি ঘিরে বিতর্ক তুঙ্গে।

চিত্রনায়িকা নুসরাত ফারিয়ার সাম্প্রতিক গ্রেপ্তারের ঘটনায় দেশের বিনোদন অঙ্গনে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও আলোচনা। এই ঘটনায় সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং শিল্পী সমাজ—সব পক্ষের দৃষ্টি এখন একযোগে এই ঘটনার দিকে। তবে সবচেয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির রহস্যজনক নীরবতা।

নুসরাত ফারিয়া শুধু একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রীই নন, তিনি একজন সংগঠিত শিল্পী হিসেবেও পরিচিত। তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সদস্য। স্বাভাবিকভাবে প্রত্যাশা ছিল, যেকোনো ধরনের আইনি জটিলতায় তার পাশে দাঁড়াবে সংগঠনটি। কিন্তু এ ঘটনায় কোনো বিবৃতি, সহানুভূতি বা ন্যূনতম প্রতিক্রিয়াও জানায়নি চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি। তাদের এই নিরবতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শোবিজ সংশ্লিষ্ট অনেকেই।

বিব্রতকর বললেন ফারুকী

সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা ও খ্যাতিমান নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বিষয়টি নিয়ে সরাসরি কথা বলেন। তিনি বলেন, “এটি শুধু একজন শিল্পীর ব্যক্তিগত অপমান নয়, বরং পুরো শিল্প সমাজের জন্য একটি বিব্রতকর ঘটনা।” তিনি আরও বলেন, “শিল্পীদের সম্মান রক্ষা করা রাষ্ট্র ও সমাজের যৌথ দায়িত্ব। কোনো শিল্পীকে হয়রানিমূলকভাবে গ্রেপ্তার করা হলে তা শিল্প ও সংস্কৃতির ওপর সরাসরি আঘাত বলে বিবেচিত হয়।”

সরাসরি অবস্থান নিলো অভিনয় শিল্পী সংঘ

এই ঘটনার প্রেক্ষিতে টেলিভিশন অভিনয়শিল্পীদের সংগঠন ‘অভিনয় শিল্পী সংঘ’ দ্রুত এবং সরবভাবে তাদের অবস্থান জানিয়েছে। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আজাদ আবুল কালাম স্বাক্ষরিত এক কড়া ভাষার বিবৃতিতে বলা হয়,

“অভিনয়শিল্পীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক গ্রেপ্তার, মামলা ও হামলায় নানা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা তৈরি হয়, যা শিল্পী ও তার পরিবারের স্বাভাবিক জীবনকে বিঘ্নিত করে।”

তারা আরও বলেন,

“শিল্পীদের সম্মান রক্ষা করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে এমন কোনো উদাহরণ তৈরি করা যাবে না, যা দেখে ভবিষ্যতের শিল্পীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।”

চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির বিভ্রান্তিকর অবস্থান

এই ঘটনার পর সাংবাদিকরা যোগাযোগ করলে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির মুখপাত্র জয় চৌধুরী বলেন, “শিল্পী হোক আর যে হোক, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।” সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদকও একই রকম বক্তব্য দেন। তারা জানান, সংগঠনের সভাপতি মিশা সওদাগর এবং সাধারণ সম্পাদক ডিপজল বর্তমানে দেশের বাইরে থাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি।

তবে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন—একজন সদস্যকে নিয়ে সমিতির এমন দায়সারা মনোভাব কি প্রকৃতপক্ষে একটি সংগঠনের দায়িত্বশীলতার প্রতিফলন? একই সময়ে অভিনয় শিল্পী সংঘ বিবৃতি দিয়ে শিল্পীর পাশে দাঁড়াতে পারলে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি কেন পারলো না?

সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ ও সমর্থন

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সমালোচনা শুরু হয়েছে এই বিষয়টি নিয়ে। চলচ্চিত্র অঙ্গনের অনেক অভিনেতা, নির্মাতা, কস্টিউম ডিজাইনার, সহকারী পরিচালক ও কলাকুশলীরা নুসরাত ফারিয়ার প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন। একইসঙ্গে তারা প্রশ্ন তুলেছেন—“চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির কাজ কী শুধুই সদস্যপদ নবায়ন ও নির্বাচন?”

একজন সিনিয়র অভিনেতা সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, “শিল্পীর দুঃসময়ে পাশে না দাঁড়ানো মানে সংগঠন নিজেই নিজের অস্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ করছে।”

শিল্পী সমাজে বিভক্তি?

এই ঘটনাটি শুধু নুসরাত ফারিয়াকে ঘিরে নয়, বরং চলচ্চিত্র অঙ্গনের দুই বড় সংগঠনের অবস্থান নিয়ে শিল্পীদের মধ্যে নতুন এক বিভাজন তৈরি করেছে। অনেকে মনে করছেন, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি মূলত গুটিকয়েক প্রভাবশালী ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকায় ন্যায্য বিষয়ে সংগঠনের পক্ষ থেকে দ্রুত প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় না। অন্যদিকে অভিনয় শিল্পী সংঘ অপেক্ষাকৃত সক্রিয়, স্বচ্ছ ও সদস্যকেন্দ্রিক একটি সংগঠন হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।

আইনের শাসন বনাম শিল্পীর নিরাপত্তা

চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির মুখপাত্রের বক্তব্যে “আইনের ঊর্ধ্বে নয়” কথাটি উঠে এলেও প্রশ্ন উঠছে—এই আইন প্রয়োগ কতটা ন্যায্য ছিল? আদৌ কি নুসরাত ফারিয়াকে যে প্রক্রিয়ায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা যুক্তিযুক্ত? নাকি এটিও কোনো রাজনৈতিক বা প্রভাবশালী পক্ষের চাপের ফল?

আইনের শাসনের প্রতি সম্মান জানিয়ে বলতে হয়, গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া যদি হয়রানিমূলক হয় কিংবা কারও ভাবমূর্তি নষ্ট করতেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা হয়, তবে সেটি শুধু একজন শিল্পীর নয়, পুরো শিল্প সমাজের জন্য বিপজ্জনক বার্তা বহন করে।

সমাধান কোথায়?

এই ধরনের ঘটনায় শোবিজ অঙ্গনের পেশাদার সংগঠনগুলোর মধ্যে সমন্বয় থাকা প্রয়োজন। শিল্পীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে সেটি অবশ্যই তদন্তের মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে। গ্রেপ্তারের মতো চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট সংগঠন, আইনজীবী ও পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ থাকা দরকার।

চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির মতো প্রভাবশালী সংগঠন যদি কোনো সদস্যের দুঃসময়ে পাশে না দাঁড়ায়, তবে সেই সংগঠনের কার্যকারিতা ও নেতৃত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। অন্যদিকে, অভিনয় শিল্পী সংঘ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, সেটি একটি সংগঠনের দায়িত্বশীল আচরণের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য।


নুসরাত ফারিয়ার গ্রেপ্তার শুধুমাত্র একজন তারকার ঘটনা নয়, এটি শিল্পীদের সংগঠিত ও সুরক্ষিত থাকার প্রয়োজনীয়তার একটি বাস্তব উদাহরণ। শিল্পীদের পেশাগত মর্যাদা রক্ষা এবং শিল্পী সমাজে সংহতি বজায় রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর আরও দায়িত্বশীল ও সাহসী ভূমিকা পালন করা জরুরি। এই ঘটনার সঠিক তদন্ত ও ন্যায়বিচার যেমন প্রয়োজন, তেমনি ভবিষ্যতে শিল্পীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও সংশ্লিষ্টদের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button