বিস্ময়ের মুহূর্ত আকাশে আগুন, দক্ষতায় রক্ষা পেলো ২৯০ প্রাণ

ঢাকা থেকে উড্ডয়নের পরপরই তার্কিশ এয়ারলাইনসের একটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ছেড়ে যাওয়া TK713 নামক ফ্লাইটটি যখন আকাশে উঠে মাত্র ১৫ মিনিট পেরিয়েছে, তখনই শুরু হয় নাটকীয় পরিস্থিতি। বিমানের এক ইঞ্জিনে দেখা যায় স্পার্ক বা আগুনের ঝলকানি। পাইলটের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত ও দক্ষতায় ভয়াবহ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন বিমানে থাকা ২৯০ জন যাত্রী ও ক্রু সদস্য।
ঘটনাটি ঘটে মঙ্গলবার (২০ মে) সকালে। স্থানীয় সময় সকাল ৭টা নাগাদ TK713 ফ্লাইটটি বাংলাদেশ থেকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। উড্ডয়নের পর আকাশে উঠতেই হঠাৎ পাইলট লক্ষ্য করেন যে ডান পাশের একটি ইঞ্জিন থেকে আগুনের ঝলক দেখা যাচ্ছে।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ও নিরাপদে জরুরি অবতরণ
ইঞ্জিনে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বুঝে পাইলট দ্রুততার সঙ্গে বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং জরুরি অবতরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এরপর প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে বিমানটি আকাশে চক্কর কাটে, যাতে জ্বালানির পরিমাণ কমে যায় ও অবতরণের সময় বিস্ফোরণের ঝুঁকি না থাকে।
অবশেষে সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে বিমানের কৌশলী অবতরণ ঘটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। এই সময় রানওয়েতে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও উদ্ধারকর্মীদের। বিমানের ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জরুরি অবতরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এবং যাত্রীদের ধীরে ধীরে নিরাপদে নামিয়ে আনা হয়।
প্রাথমিক ধারণা: বার্ড হিট হতে পারে কারণ
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এস এম রাগীব সামাদ জানান, বিমানের ইঞ্জিনে স্পার্ক দেখা দেয়ার পর বার্ড হিট বা পাখির সঙ্গে সংঘর্ষের সম্ভাবনা প্রাথমিকভাবে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, “বিমানের ইঞ্জিনে পাখি ঢুকে গেলে এই ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে। তবে বিস্তারিত জানার জন্য তদন্ত শুরু হয়েছে।”
এয়ারবাস এ৩৩০-৩০৩ মডেলের এই TK713 ফ্লাইটে যাত্রী ছিলেন প্রায় ২৯০ জন। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কারো কোনো আঘাত লাগেনি এবং যাত্রীরা সকলেই নিরাপদে রয়েছেন।
যাত্রীদের অভিজ্ঞতা: ‘আমরা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছি’
ঘটনার পর যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। কেউ কেউ বিমানের জানালার বাইরে আগুনের চিহ্ন দেখতে পান এবং চিৎকার করে ওঠেন। যাত্রীদের অনেকেই বলেন, তারা ভেবেছিলেন হয়তো এবার আর বাঁচা হবে না।
একজন যাত্রী গণমাধ্যমকে জানান, “বিমান যখন টেকঅফ করলো তখন সব স্বাভাবিক ছিল। হঠাৎ জানালার পাশ দিয়ে কালো ধোঁয়া আর আগুনের ঝলকানি দেখে আমরা আঁতকে উঠি। পাইলট ও কেবিন ক্রুরা আমাদের শান্ত রাখার চেষ্টা করেন।”
এয়ারলাইনসের ব্যবস্থা ও যাত্রীদের সহায়তা
তার্কিশ এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ জানায়, বিমানের ইঞ্জিনে সমস্যা ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা সকল যাত্রীকে বিকল্প ফ্লাইটে পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তাৎক্ষণিকভাবে যাত্রীদের বিমানবন্দর সংলগ্ন হোটেলগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং খাবার, থাকা ও প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা হয়।
এক বিবৃতিতে এয়ারলাইনস জানায়, “আমরা আমাদের যাত্রীদের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেই। আমাদের কর্মীরা ঘটনার পরপরই যাত্রীদের সহায়তায় কাজ শুরু করেছে। TK713 ফ্লাইটের যাত্রীরা খুব শিগগিরই অন্য একটি ফ্লাইটে করে ইস্তাম্বুল যাত্রা করবেন।”
সম্প্রতি বাংলাদেশে বিমান দুর্ঘটনার পরিমাণ বেড়েছে?
এই ঘটনার মাত্র চার দিন আগেই, অর্থাৎ ১৬ মে কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটের ল্যান্ডিং গিয়ারের একটি চাকা খুলে নিচে পড়ে গিয়েছিল। তখনও পাইলটের দক্ষতায় বড় দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়েছিল।
গত এক বছরে এমন আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে যা এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। যদিও আন্তর্জাতিক উড্ডয়ন নিয়ম অনুযায়ী, যেকোনো ঘটনা তদন্তের মাধ্যমে কারণ নির্ধারণ করা হয় এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
বিশেষজ্ঞদের মত: বার্ড হিট ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা
বাংলাদেশের এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকায় পাখির সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব এই ধরনের বার্ড হিটের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফারুক হোসেন বলেন, “বিমানবন্দরের আশেপাশে খোলা ডাস্টবিন, মাছ বাজার ও উন্মুক্ত বর্জ্য ফেলানোর কারণে কাক, চিলসহ বিভিন্ন পাখি ওই এলাকায় ঘোরাফেরা করে। এতে করে বার্ড হিটের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এই বিষয়টি নিয়ে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর হতে হবে।”
নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে?
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (CAAB) জানিয়েছে, তারা ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে এবং প্রয়োজনে পাখি তাড়ানোর জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের কথাও ভাবা হচ্ছে। এ ছাড়া রানওয়ের আশেপাশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করতে সিটি করপোরেশন ও অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে যৌথ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
পাইলটের দক্ষতায় রক্ষা পেল ২৯০ প্রাণ
এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করে দিল যে দক্ষ পাইলট ও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণই বড় দুর্ঘটনা এড়াতে পারে। যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীলতা এবং প্রযুক্তিগত আধুনিকায়নের বিকল্প নেই।
অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়া এই TK713 ফ্লাইটের যাত্রীরা আজ হয়তো বাড়ি ফিরে ঈদের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তবে তারা সারাজীবন ভুলতে পারবেন না সেই সকালের আতঙ্কের মুহূর্ত।