বানিজ্য

ভাঙ্গা-কুয়াকাটা ছয় লেন প্রকল্পের অনুমোদন: বরিশালের উন্নয়নে নতুন দিগন্ত

বাংলাদেশ সরকার জনগুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভাঙ্গা-কুয়াকাটা সড়ককে ছয় লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে। এই মেগা প্রকল্প বরিশাল বিভাগের যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের পাশাপাশি অঞ্চলটির অর্থনৈতিক ও শিল্পায়নের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। সোমবার (১৯ মে) বরিশাল সার্কিট হাউসে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এ তথ্য জানান।

সভায় উপদেষ্টা বলেন, “ভাঙ্গা-কুয়াকাটা ছয় লেন প্রকল্প বরিশালের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এটি কেবল একটি সড়ক নির্মাণ প্রকল্প নয়, বরং দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর একটি মাধ্যম।” তিনি আরও জানান, সরকার আমদানি-রপ্তানিনির্ভর এবং অঞ্চলভিত্তিক অগ্রাধিকার প্রকল্প বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বরিশাল বিভাগের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের সংযোগ আরও সহজ ও দ্রুততর হবে, যা বাণিজ্য ও বিনিয়োগের নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে।

প্রকল্পের তাৎপর্য ও প্রভাব

ভাঙ্গা-কুয়াকাটা ছয় লেন প্রকল্পটি ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। এই সড়ক বরিশাল বিভাগের প্রধান শহরগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে পর্যটন, বাণিজ্য ও শিল্পের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বিশেষ করে কুয়াকাটা, যা একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র, এই প্রকল্পের ফলে আরও সহজলভ্য হবে। পর্যটকদের জন্য দ্রুত ও নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত হওয়ায় কুয়াকাটার পর্যটন শিল্পে নতুন গতি সঞ্চারিত হবে।

এছাড়া, এই প্রকল্পটি স্থানীয় কৃষি পণ্যের পরিবহন ও বিপণনকে সহজতর করবে। বরিশালের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি এই উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের অন্যান্য বাজারের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে সংযুক্ত হবে। ফলে কৃষকরা তাদের পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাবেন এবং অঞ্চলটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে।

সামাজিক নিরাপত্তা ও দারিদ্র্যবিমোচন

মতবিনিময় সভায় উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চলমান দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি বলেন, “দারিদ্র্যবিমোচন ও সামাজিক নিরাপত্তা সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সৃষ্ট কর্মসংস্থানের সুযোগ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক হবে।” প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় স্থানীয় শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে অঞ্চলটির বেকারত্ব হ্রাস পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এছাড়া, তিনি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার শক্তিশালীকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, “জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে দক্ষ ও সৎ জনপ্রতিনিধির কোনো বিকল্প নেই। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করতে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।”

বরিশালের অন্যান্য উন্নয়ন পরিকল্পনা

মতবিনিময় সভায় বরিশালবাসীর বিভিন্ন দাবির প্রেক্ষিতে উপদেষ্টা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি জানান, শহরের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে খাল পুনঃখনন, বরিশাল-বানারিপাড়া সন্ধ্যা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ, নথুল্লাবাদ থেকে দপদপিয়া পর্যন্ত বাইপাস সড়ক, ফুট ওভারব্রিজ এবং উন্নতমানের ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বাস্তবায়নে সরকার সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। এসব প্রকল্প বরিশালের নগর পরিকল্পনা ও জনজীবনের মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বরিশালের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রতিও সরকারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, “কবি জীবনানন্দ দাশের স্মৃতিকে ধরে রাখতে বরিশালে একটি আধুনিক পাঠাগার নির্মাণ করা হবে। এছাড়া, অঞ্চলটির ঐতিহ্য সংরক্ষণে সরকার সব ধরনের পদক্ষেপ নেবে।” এই প্রতিশ্রুতি স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।

স্থানীয় নেতৃবৃন্দের প্রতিক্রিয়া

সভায় উপস্থিত বরিশাল চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এবায়দুল হক চান বলেন, “ভাঙ্গা-কুয়াকাটা ছয় লেন প্রকল্প বরিশালের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এটি আমাদের অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে নতুন দ্বার উন্মোচন করবে।” তিনি সরকারের এই উদ্যোগের প্রশংসা করে এটি দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।

বরিশাল আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সাদিকুর রহমান লিংকন বলেন, “এই প্রকল্প শুধু যোগাযোগের উন্নয়নই নয়, বরিশালের সামগ্রিক উন্নয়নের একটি রূপরেখা। আমরা আশা করি, সরকার এই প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে।”

প্রকল্প বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

ভাঙ্গা-কুয়াকাটা ছয় লেন প্রকল্পের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভূমি অধিগ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও ন্যায্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা হবে। এছাড়া, পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় প্রকল্পটি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও পদ্ধতি ব্যবহার করবে।

প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিশদ নকশা প্রণয়ন ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এটি ২০৩০ সালের মধ্যে সম্পন্ন হবে। তবে, স্থানীয় জনগণ ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এটি আরও দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে।

উপসংহার

ভাঙ্গা-কুয়াকাটা ছয় লেন প্রকল্প বরিশালের উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটি কেবল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিই নয়, বরং অঞ্চলটির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের পথে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে। সরকারের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি এবং স্থানীয় জনগণের সহযোগিতার মাধ্যমে এই প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে বরিশাল বিভাগ দেশের অন্যতম অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button