শাওমির ‘এক্সরিং ০১’ চিপ: স্যামসাং এক্সিনসকে পেছনে ফেলার পথে চীনা প্রযুক্তি জায়ান্ট

বিশ্ব প্রযুক্তির বাজারে এক নতুন চমক নিয়ে হাজির হয়েছে চীনা স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান শাওমি। বহুল প্রতীক্ষিত নিজেদের প্রথম ফ্ল্যাগশিপ প্রসেসর ‘Xiaomi Surge Xringe 01’ অবশেষে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচন করলো প্রতিষ্ঠানটি। শাওমির প্রধান নির্বাহী লেই জুন এই চিপের আত্মপ্রকাশ ঘোষণা করেন, যেটি পারফরম্যান্সের দিক থেকে স্যামসাংয়ের এক্সিনস ২৪০০ ও ২৬০০ চিপের মতো উন্নত চিপসেটের সঙ্গে সরাসরি প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
এটি কেবল শাওমির নিজস্ব প্রযুক্তিগত সক্ষমতার একটি বড় মাইলফলক নয়, বরং বিশ্ব স্মার্টফোন চিপ বাজারে চীনা কোম্পানিগুলোর বাড়তে থাকা আধিপত্যেরও প্রমাণ।
শাওমির ‘এক্সরিং ০১’ চিপ: কারিগরি বৈশিষ্ট্য ও উদ্ভাবনের পেছনের গল্প
‘এক্সরিং ০১’ চিপটি তৈরি হয়েছে এআরএম (ARM)-এর সর্বাধুনিক আর্কিটেকচারের ভিত্তিতে। এটি তৈরি করেছে বিশ্বখ্যাত সেমিকন্ডাক্টর প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান TSMC (Taiwan Semiconductor Manufacturing Company)। TSMC এই চিপ তৈরিতে ব্যবহার করেছে তাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের ৩ ন্যানোমিটার (3nm) প্রযুক্তি, যা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত চিপ উৎপাদন প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত।
এই চিপ তৈরির পেছনে সময় লেগেছে প্রায় চার বছর এবং এতে কাজ করেছেন ২,৫০০-এর বেশি প্রকৌশলী ও গবেষক। চিপটির উন্নয়নে খরচ হয়েছে প্রায় ১.৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এতে ব্যবহার করা হয়েছে ১৯ বিলিয়নেরও বেশি ট্রানজিস্টর – যা এটি সুপার কম্পিউটিং সক্ষমতার কাছাকাছি নিয়ে যায়।
স্যামসাং, কোয়ালকম ও অ্যাপলের সঙ্গে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা
বর্তমানে বিশ্বের বড় চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে স্যামসাং, কোয়ালকম, অ্যাপল ও হুয়াওয়ে। এদের মধ্যে অ্যাপল তাদের নিজস্ব A সিরিজ ও M সিরিজ চিপ তৈরি করে আসছে, হুয়াওয়ে তৈরি করছে কিরিন (Kirin) সিরিজ, গুগল নিয়ে এসেছে টেনসর (Tensor) এবং স্যামসাং তৈরি করেছে এক্সিনস (Exynos)।
এতদিন শাওমি কোয়ালকম ও মিডিয়াটেকের চিপের ওপর নির্ভর করতো। কিন্তু এবার তারা সরাসরি নিজেদের শক্ত অবস্থান গড়ে তোলার জন্য ইন-হাউস চিপ তৈরির পথে হাঁটছে। ‘এক্সরিং ০১’ চিপটি তাদের সেই প্রয়াসের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ফল।
গিকবেঞ্চ ৬ (Geekbench 6)-এর বেঞ্চমার্ক অনুযায়ী, এই চিপ সিঙ্গেল কোর পারফরম্যান্সে ৩,১১৯ এবং মাল্টিকোরে ৯,৬৭৩ পয়েন্ট অর্জন করেছে। তুলনামূলকভাবে এটি কোয়ালকমের সাম্প্রতিকতম Snapdragon 8 Elite চিপের কাছাকাছি, এবং স্যামসাংয়ের Exynos 2400-এর চেয়েও এগিয়ে রয়েছে।
স্মার্টফোনে ব্যবহারের পরিকল্পনা
শাওমির পক্ষ থেকে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি, তারা ঠিক কোন স্মার্টফোনে এই নতুন চিপ ব্যবহার করবে। তবে প্রযুক্তিবিদদের ধারণা, শাওমির পরবর্তী ফ্ল্যাগশিপ সিরিজ—সম্ভবত Xiaomi 15 Ultra বা নতুন কোনো এক্সক্লুসিভ মডেলে—এই চিপ প্রথম দেখা যেতে পারে।
শাওমি এই চিপের মাধ্যমে যেসব দিকগুলোতে ফোকাস দিয়েছে তা হলো:
- শক্তিশালী এআই পারফরম্যান্স
- উন্নত গেমিং পারফরম্যান্স
- শক্তিশালী ব্যাটারি অপ্টিমাইজেশন
- উচ্চতর ফটোগ্রাফি প্রসেসিং সক্ষমতা
শাওমির চিপ ইতিহাসে এক ধাপ এগিয়ে
শাওমির চিপ নির্মাণের ইতিহাস একেবারে নতুন নয়। ২০১৭ সালে তারা ‘Surge S1’ নামে একটি মাঝারি মানের চিপ তৈরি করেছিল, যা ‘Mi 5c’ মডেলে ব্যবহৃত হয়। ২০১৮ সালে তারা ঘোষণা দিয়েছিল ‘Surge S2’-এর, কিন্তু তা আর বাজারে আনা হয়নি।
‘Xringe 01’ শাওমির প্রথম হাই-এন্ড বা ফ্ল্যাগশিপ ক্লাস চিপ, যা সরাসরি Apple, Samsung ও Qualcomm-এর মতো প্রতিষ্ঠানের প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে।
স্যামসাংয়ের চ্যালেঞ্জ: ৩ ন্যানোমিটারে পিছিয়ে পড়া?
স্যামসাং তাদের এক্সিনস ২৪০০ চিপটি ৪ ন্যানোমিটার প্রযুক্তিতে তৈরি করেছিল, যা ছিল তাদের সবচেয়ে উন্নত চিপগুলোর একটি। তবে তারা ৩ ন্যানোমিটার প্রযুক্তিতে আসতে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। গুঞ্জন রয়েছে, স্যামসাং ২০২৫ সালে তাদের প্রথম ৩ ন্যানোমিটার চিপ ‘Exynos 2500’ আনতে চেয়েছিল, যার কোডনেম ছিল ‘ড্রিম চিপ’।
তবে উৎপাদনে কম সফলতা পাওয়ায় এই প্রকল্প সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। এখন ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ সালের জুলাইয়ে গ্যালাক্সি জেড ফ্লিপ ৭-এর সঙ্গে এই চিপ উন্মোচন করা হতে পারে।
শাওমির এই সাফল্য কেন গুরুত্বপূর্ণ?
শাওমির এই অর্জন শুধু তাদের ব্র্যান্ড ভ্যালু বৃদ্ধিই করছে না, বরং এটি চীনা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের প্রতীক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নানা ধরনের প্রযুক্তি নিষেধাজ্ঞার মুখে হুয়াওয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বিপাকে পড়লেও, শাওমি এই পথে এগিয়ে বিশ্বে নিজেদের একটি নির্ভরযোগ্য ও শক্তিশালী প্রযুক্তি শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে।
চিপ নির্মাণে স্বনির্ভরতা মানেই প্রযুক্তিগত স্বাধীনতা, যা ভবিষ্যতে গ্লোবাল টেক ওয়ারে (Tech War) বড় একটি হাতিয়ার হয়ে উঠবে।
‘এক্সরিং ০১’-এর মাধ্যমে শাওমি শুধু একটি চিপ তৈরি করেনি, বরং এটি একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে, তারা ভবিষ্যতের প্রযুক্তির দৌড়ে পিছিয়ে থাকবে না। তাদের এই চিপ যদি সত্যিই বাজারে প্রতিশ্রুত পারফরম্যান্স দেখাতে পারে, তাহলে কোয়ালকম, অ্যাপল এবং স্যামসাংয়ের মতো জায়ান্টদের সঙ্গে টেক্কা দিতে তারা পুরোপুরি প্রস্তুত।
আগামী দিনে স্মার্টফোন বাজারে চিপসেট দৌড়ে শাওমির নামটাও অন্যতম আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে, সেটাই এখন সময়ের অপেক্ষা।