ফারাক্কা চুক্তির মেয়াদ নিয়ে এখনই উদ্বেগের সময় নয় পরিবেশ উপদেষ্টা

বাংলাদেশ-ভারতের বহুল আলোচিত ফারাক্কা পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে এখনই উদ্বেগের কিছু নেই বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তাঁর ভাষায়, “এই মুহূর্তে ফারাক্কা চুক্তি নিয়ে আলোচনার সময় আসেনি। যথাসময়ে চুক্তির মেয়াদ নবায়ন করা হবে।”
সোমবার (১৯ মে) রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার বড়াল নদীর উৎসমুখ পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। এসময় স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা, পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি এবং গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
ফারাক্কা চুক্তি: সময়োপযোগী নবায়নের প্রতিশ্রুতি
১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত ৩০ বছরের গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি ২০২৬ সালে শেষ হচ্ছে। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর আগেই এ বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে পরিবেশ উপদেষ্টার মতে, বিষয়টি নিয়ে অহেতুক জল্পনা না করে কূটনৈতিক পদ্ধতিতে যথাসময়ে কাজ সম্পন্ন হবে।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। অতীতে যেভাবে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হয়েছে, এবারও হবে। আমরা প্রস্তুত আছি এবং সার্বিক পরিবেশ মূল্যায়নের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
বড়াল নদী ও আঞ্চলিক পানিসম্পদের সংকট
পরিদর্শনের সময় উপদেষ্টা বড়াল নদীর দূষণ ও পানিপ্রবাহ হ্রাসের বাস্তব চিত্র দেখেন। তিনি বলেন, “প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বার্থে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে কোনো রকম বাধা রাখা যাবে না। নদী দখল ও ভরাট আমাদের পরিবেশের জন্য বড় হুমকি।”
বড়াল নদীতে একাধিক অকার্যকর স্লুইসগেট নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, “এ নদীতে স্লুইসগেটের আর কোনো প্রয়োজন নেই। এতে জলজ প্রাণী, চাষাবাদ এবং পানিপ্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে।”
বালু ও ভূমি দস্যুতা রোধে ১০ দফা নির্দেশনা
উপদেষ্টা জানান, দেশে বালু ও ভূমি দস্যুতা এখন চরম আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে ফসলি জমিতে পুকুর খনন ও অবৈধভাবে নদী দখলের ঘটনা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে।
“এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আমরা জেলা প্রশাসকদের জন্য ১০ দফা নির্দেশনা জারি করেছি। প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকায় এসব অনিয়ম দমন সম্ভব,” বলেন তিনি।
উল্লেখযোগ্য দফাগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- ফসলি জমিতে অনুমতি ছাড়া খনন বন্ধ,
- বালু উত্তোলনে লাইসেন্সবিহীন কার্যক্রমে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা,
- নদী ও খাল দখলকারীদের তালিকা প্রস্তুত,
- পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া প্রকল্প অনুমোদন না দেওয়া।
সমন্বিত উদ্যোগে নদী রক্ষা পরিকল্পনা
নদী খনন, প্রবাহ ফিরিয়ে আনা, তীর সংরক্ষণ এবং পানি ব্যবস্থাপনায় একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়ার ঘোষণা দেন উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “আমাদের সব নদী সংরক্ষণ করতে হলে শুধু পরিবেশ মন্ত্রণালয় নয়—পানি উন্নয়ন বোর্ড, এলজিইডি, ভূমি ও কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।”
তিনি আরো বলেন, “নদীর উৎস মুখ থেকে শুরু করে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত একটি পূর্ণাঙ্গ ‘নদী ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা’ তৈরি হচ্ছে। এতে স্থানীয় জনগণকেও সম্পৃক্ত করা হবে।”
চুক্তির মেয়াদ নবায়ন নিয়ে কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি জরুরি
ফারাক্কা বাঁধ সংক্রান্ত পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে অতীতে বহুবার রাজনৈতিক চাপ ও জনমত সৃষ্টি হয়েছে। তবে এবার সরকারের কৌশলগত নীতি হল—অতীত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আলোচনার মাধ্যমে ফলপ্রসূ সমাধানে পৌঁছানো।
পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, “আমরা আলোচনার মাধ্যমেই ফারাক্কা ইস্যুতে আগাবো। পরিবেশগত ভারসাম্য এবং জনগণের স্বার্থ আমাদের অগ্রাধিকার। জলবায়ু পরিবর্তন এবং ঋতুচক্রের বৈচিত্র্যের কারণে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা এখন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।”
ভবিষ্যতের জন্য টেকসই পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা জরুরি
বাংলাদেশের পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে উপদেষ্টা জানান, এখন থেকে প্রকল্প অনুমোদনের সময়ই পরিবেশগত ঝুঁকি বিশ্লেষণ বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, “এখন আর নদীর গতিপথ রোধ করে প্রকল্প করা যাবে না। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য টেকসই পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।”
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের এই সফর এবং বক্তব্য বাংলাদেশের পানি নীতিতে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত দেয়। ফারাক্কা চুক্তির নবায়ন, নদী দখল বন্ধ, ভূমি ও বালু দস্যুতা দমন, এবং সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনা—এই চারটি বিষয়ে সরকারের দিকনির্দেশনামূলক অবস্থান প্রকাশ পেয়েছে।
বর্তমান বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট ও উপমহাদেশীয় পানি রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশ যেমন পানির ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে পারবে, তেমনি পরিবেশ ও কৃষির ভবিষ্যৎও আরও নিরাপদ হবে।