বিশ্ব

ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ শেষে চীন সফরে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রতিক উত্তেজনার আবহে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের আসন্ন চীন সফরকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ১৯ থেকে ২১ মে পর্যন্ত তার এই সফর শুধু পাকিস্তান-চীন কৌশলগত সম্পর্কের গভীরতাই প্রকাশ করছে না, বরং ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির পরবর্তী সময়ের আঞ্চলিক কূটনৈতিক ভারসাম্যের প্রতিও দিকনির্দেশ করছে।

চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র আমন্ত্রণে অনুষ্ঠিতব্য এই সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা, সাম্প্রতিক দক্ষিণ এশীয় সংকট এবং আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। এই সফর এমন একটি সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী সংঘাত মাত্রই যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে থেমেছে এবং পুরো অঞ্চল এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি।

যুদ্ধ ও যুদ্ধবিরতির প্রেক্ষাপট

সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের সূচনা হয় গত মাসে জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে একটি সন্ত্রাসী হামলার মধ্য দিয়ে। সেখানে ২৬ জন ভারতীয় পর্যটক নিহত হন। ভারত এই হামলার জন্য সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করলেও এখনো কোনো প্রমাণ আন্তর্জাতিক মহলে উপস্থাপন করেনি। এর পর থেকেই দুদেশের মধ্যে উত্তেজনা চরমে ওঠে এবং সীমান্ত জুড়ে শুরু হয় পূর্ণমাত্রার সামরিক লড়াই।

ভারতীয় সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সিঁদুর’ নাম দিয়ে আক্রমণাত্মক অভিযান শুরু করলে, পাকিস্তান ‘অপারেশন বুনিয়ানুম-মারসুস’ নামে পাল্টা সামরিক প্রতিরোধ চালায়। পাকিস্তানের দাবি, তাদের অভিযান ছিল সুপরিকল্পিত, আনুপাতিক ও প্রতিরক্ষামূলক। সংঘাত চলাকালীন পাকিস্তান ভারতীয় ছয়টি যুদ্ধবিমান (তিনটি রাফালসহ) এবং অসংখ্য ড্রোন ভূপাতিত করেছে।

এই যুদ্ধ চলেছে প্রায় ৮৭ ঘণ্টা। তীব্র সংঘর্ষে পাকিস্তানে ১৩ জন সেনা সদস্যসহ মোট ৫৩ জন নিহত হন বলে আইএসপিআরের বরাতে জানা গেছে। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ১০ মে একটি যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছায় দুই দেশ। কিন্তু উত্তেজনার পারদ এখনও পুরোপুরি কমে আসেনি।

চীনের ভূমিকা ও ‘আয়রন ব্রাদারশিপ’

এই সময়েই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চীনের ভূমিকাও নতুন মাত্রা পেয়েছে। যুদ্ধ চলাকালীন বেইজিং পাকিস্তানের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন জানায়। চীনের পররাষ্ট্র দপ্তর এক বিবৃতিতে জানায়, তারা ‘আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পাকিস্তানের পাশে থাকবে’। বেইজিংয়ে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত পাকিস্তানকে ‘আয়রন ব্রাদার’ আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘চ্যালেঞ্জপূর্ণ সময়ে চীন ও পাকিস্তান সব সময় একে অপরের পাশে থেকেছে’।

এমন বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে ইসহাক দারের চীন সফরকে কৌশলগত বন্ধনের দৃঢ়ীকরণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। চীনের সঙ্গে এই সম্পর্ক পাকিস্তানের জন্য শুধু একটি আঞ্চলিক সহায়তা নয়, বরং ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক ভারসাম্য গঠনের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।

ত্রিপক্ষীয় বৈঠক ও আফগান প্রাসঙ্গিকতা

এই সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো চীন-পাকিস্তান-আফগানিস্তান ত্রিপক্ষীয় বৈঠক। তালেবান শাসিত আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুততাকি ২০ মে চীনে পৌঁছাবেন এবং তিনি এই ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেবেন। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হবে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার যৌথ কৌশল।

চীন এই বৈঠকের মাধ্যমে নিজেদের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার নেতৃত্বে একটি আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্ম গঠনের চেষ্টায় রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষত তালেবান সরকারকে কিছুটা স্বীকৃতি ও আলাপ-আলোচনায় যুক্ত করার মাধ্যমে চীন নিজেকে সমস্যা সমাধানের একটি বিশ্বাসযোগ্য শক্তি হিসেবে তুলে ধরছে।

কূটনৈতিক বিশ্লেষণ: দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক থেকে আঞ্চলিক প্রভাব

পাক-চীন সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবেই ঘনিষ্ঠ। ১৯৬৩ সালে সীমান্ত চুক্তি এবং পরে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC) চালু হওয়ার পর থেকে এ সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়েছে। সাম্প্রতিক চীন সফর সেই সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে সহায়ক হতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই সফর শুধু পাকিস্তান-চীন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নয়, বরং ভারত-পাকিস্তান কূটনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রেক্ষাপটেও গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তান এই সফরের মাধ্যমে চীনকে সঙ্গে রেখে আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের ‘আগ্রাসী’ অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করতে চায়।

পাশাপাশি, চীনও এই সুযোগে ভারতের কৌশলগত প্রভাব খর্ব করে দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী। এতে ত্রিপক্ষীয় কাঠামো, অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং নিরাপত্তা অংশীদারিত্ব—সবই নতুন করে গুরুত্ব পাচ্ছে।

যুদ্ধবিরতির পরবর্তী সম্ভাব্য পথনির্দেশ

বর্তমানে যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হলেও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক এখনো অত্যন্ত নাজুক। রাজনৈতিক উত্তেজনা, সীমান্তের অস্থিরতা এবং আন্তর্জাতিক চাপ—সব মিলিয়ে আগামী দিনগুলোতে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে, তা অনেকটাই নির্ভর করছে চীন সফর ঘিরে কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনার ওপর।

পাকিস্তান চাইছে যুদ্ধবিরতির পরিবেশ অটুট রাখতে এবং চীনের সহযোগিতায় ভারতের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা হ্রাস করতে। অপরদিকে, ভারত এখনও কাশ্মীর হামলার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালাচ্ছে।

চীন সফর থেকে পাকিস্তান যদি কৌশলগত সমর্থন, অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত সহায়তা আদায় করতে পারে, তবে এটি একটি বড় কূটনৈতিক জয় হবে ইসহাক দারের জন্য।

উপসংহার

ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত সংঘাতের প্রেক্ষিতে চীন সফর শুধু কূটনৈতিক সফর নয়, বরং তা দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও কৌশলগত ভারসাম্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। ইসহাক দারের এই সফর, ত্রিপক্ষীয় বৈঠক এবং চীনের রাজনৈতিক সমর্থন আগামী দিনে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক কোন পথে এগোবে—তা অনেকাংশে নির্ধারণ করে দেবে।

এই সফরের মাধ্যমে চীন নিজেকে আবারও ‘আঞ্চলিক শান্তির মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছে এবং পাকিস্তানও বিশ্ব কূটনীতিতে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার একটি সম্ভাবনা দেখছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button