বিশ্ব

গাজায় ‘ব্যাপক’ স্থল হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) ‘ব্যাপক’ স্থল অভিযান শুরু করেছে। রোববার (১৮ মে ২০২৫) ইসরায়েলি বাহিনী এক বিবৃতিতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। ‘অপারেশন গিডিয়ন চ্যারট’ নামে পরিচালিত এই অভিযানের লক্ষ্য ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসকে পরাজিত করা এবং তাদের হাতে আটক জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত করা। এই অভিযান গাজার উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে বিস্তৃত এবং এতে স্থায়ী ও রিজার্ভ সেনারা অংশ নিচ্ছে। তবে, এই সামরিক তৎপরতা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে।

অভিযানের বিবরণ ও লক্ষ্য

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর বিবৃতি অনুযায়ী, এই অভিযান গাজার কৌশলগত এলাকাগুলো দখল ও নিয়ন্ত্রণ করার উপর জোর দিচ্ছে। আইডিএফ দাবি করেছে, গত এক সপ্তাহে তাদের বিমানবাহিনী হামাসের ৬৭০টিরও বেশি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে হামাসের সামরিক সেল, সুড়ঙ্গ, এবং ট্যাংক বিধ্বংসী অবস্থান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই হামলাগুলোতে হামাসের বেশ কয়েকজন যোদ্ধা নিহত এবং তাদের অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে বলে আইডিএফ দাবি করেছে।

অপারেশনের নাম ‘গিডিয়ন চ্যারট’ বাইবেলের একজন যোদ্ধা গিডিয়নের নাম থেকে গৃহীত। টাইমস অব ইসরায়েলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই অভিযানের মাধ্যমে ইসরায়েলি সেনারা গাজার গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দখল করে রাখবে, বেসামরিক জনগণকে দক্ষিণে স্থানান্তর করবে, হামাসের উপর আক্রমণ চালাবে এবং ত্রাণ সরবরাহের উপর হামাসের নিয়ন্ত্রণ রোধ করবে।

ইসরায়েলি বাহিনী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানিয়েছে, তারা হামাসের উপর ‘প্রচণ্ড চাপ’ প্রয়োগ করছে এবং সংগঠনটিকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত এই অভিযান অব্যাহত থাকবে। তাদের ভাষায়, “হামাস আর হুমকি না হওয়া এবং আমাদের জিম্মিদের বাড়িতে না পাওয়া পর্যন্ত অভিযান বন্ধ হবে না।”

গাজার মানবিক সঙ্কট

ইসরায়েলি হামলার তীব্রতা বৃদ্ধির ফলে গাজায় মানবিক পরিস্থিতি উদ্বেগজনক রূপ নিয়েছে। আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক ড. মুহাম্মদ আবু সালমিয়া জানিয়েছেন, হামলার কারণে হাসপাতালগুলো চরম সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে। ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম, এবং জ্বালানির অভাবে রোগীদের চিকিৎসা প্রদান কঠিন হয়ে পড়েছে।

আলজাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, রোববার ভোর থেকে গাজার দক্ষিণ, উত্তর, এবং মধ্যাঞ্চলে ইসরায়েলি হামলায় কমপক্ষে ১৩৫ জন নিহত হয়েছেন। হামাস-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া হামলায় প্রায় ২৫০ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে শিশু এবং নারীরাও রয়েছে।

গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি হামলায় এ পর্যন্ত ৫৩ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন এবং লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। বর্তমানে হামাসের হাতে ৫৭ জন জিম্মি রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

ইসরায়েলের এই সামরিক অভিযান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার তুর্ক সতর্ক করে বলেছেন, ইসরায়েলের তীব্র আক্রমণ আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তিনি বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার উপর জোর দিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজার মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, “গাজায় অনেক মানুষ না খেয়ে আছে।” তিনি ত্রাণ সরবরাহের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তবে, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত ত্রাণ বিতরণ পরিকল্পনা জাতিসংঘ প্রত্যাখ্যান করেছে।

যুদ্ধবিরতি আলোচনা ও উত্তেজনা

একদিকে কাতারের রাজধানী দোহায় হামাস এবং ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির আলোচনা চলছে, অন্যদিকে ইসরায়েলের নতুন সামরিক অভিযান এই প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ জানিয়েছেন, হামাসের আলোচকরা জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ে পরোক্ষ আলোচনায় ফিরে এসেছে। তবে, এই অভিযান শুরুর পর হামাস জানিয়েছে, তারা নতুন করে যুদ্ধবিরতির আলোচনা শুরু করেছে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এর আগে বলেছিলেন, গাজায় তীব্র প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছে তার বাহিনী। তিনি হামাসের বিরুদ্ধে ‘পূর্ণশক্তিতে’ যুদ্ধ পুনরায় শুরুর ঘোষণা দিয়েছেন।

মধ্যপ্রাচ্যে সম্ভাব্য প্রভাব

ইসরায়েলের এই অভিযান মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। গাজার সীমান্তে ইসরায়েলি সাঁজোয়া বাহিনীর মোতায়েন এবং বিমান হামলার তীব্রতা বৃদ্ধি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। এছাড়া, হামাসের পক্ষ থেকে রকেট হামলা তীব্র করার ঘোষণা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।

বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে গাজায় ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। ১৯ মার্চ ২০২৫-এ প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ গাজার বেসামরিক নাগরিকদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছে এবং অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি

ইসরায়েল-হামাস সংঘাত ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে তীব্র আকার ধারণ করে, যখন হামাস ইসরায়েলের উপর আকস্মিক হামলা চালায়। এই হামলায় প্রায় ১২০০ ইসরায়েলি নিহত এবং ২৫১ জন জিম্মি হন। প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল ‘অপারেশন আয়রন সোর্ডস’ শুরু করে, যা এই অঞ্চলের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাতগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত হয়।

গত ১৪ মাসে এই সংঘাতে গাজায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজার প্রায় ৮০ শতাংশ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে। ২০২৫ সালের মার্চে একটি স্বল্পমেয়াদী যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েল ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ করে এবং নতুন করে হামলা শুরু করে।

ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা

ইসরায়েলের এই সামরিক অভিযান গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। হামাসের প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং জিম্মি ইস্যু এই সংঘাতের মূল বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ সত্ত্বেও ইসরায়েলের অব্যাহত হামলা এবং হামাসের প্রতিরোধ এই অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদী শান্তির সম্ভাবনাকে আরও জটিল করে তুলেছে।

গাজার বেসামরিক নাগরিকরা এই সংঘাতের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবিক সংস্থা গাজায় দুর্ভিক্ষ এবং স্বাস্থ্য সঙ্কটের বিষয়ে সতর্ক করেছে। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং কূটনৈতিক উদ্যোগ ছাড়া গাজার সঙ্কট নিরসন কঠিন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button