বাংলাদেশের বিমান পরিবহন খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী কানাডা

বাংলাদেশের দ্রুত অগ্রসরমান বিমান পরিবহন খাত আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোর কাছে যাদের প্রযুক্তি, অর্থায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়নে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় কানাডা বাংলাদেশের বিমান পরিবহন অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে, যা দেশের এ খাতের টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা।
রোববার (১৮ মে) বাংলাদেশে নিযুক্ত কানাডিয়ান হাইকমিশনার অজিত সিং ঢাকা সফরের সময় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মনজুর কবির ভূঁইয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ঢাকায় বেবিচক সদর দপ্তরে আয়োজিত এই সৌজন্য সাক্ষাতে হাইকমিশনার কানাডার পক্ষ থেকে বিমানবন্দর অবকাঠামো উন্নয়নে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে অংশীদার হওয়ার আগ্রহের কথা জানান।
অবকাঠামো উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব
বাংলাদেশের বিমান পরিবহন খাত গত এক দশকে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধন করেছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের মতো প্রধান বিমানবন্দরগুলোর সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন ইতোমধ্যেই বাস্তবায়নাধীন। নতুন করে কক্সবাজার ও বরিশালের মতো আঞ্চলিক বিমানবন্দরগুলোরও উন্নয়নে জোর দেওয়া হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে, কানাডার মতো উন্নত দেশ থেকে বিনিয়োগের আগ্রহ কেবল অর্থায়নের দিকেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং প্রযুক্তি, কারিগরি দক্ষতা এবং ব্যবস্থাপনা সংস্কৃতিতে একটি উন্নত দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত করতে পারে।
সাক্ষাতে বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, “কানাডা বিমান পরিবহন খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে এবং আমি হাইকমিশনারকে একটি আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছি। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর আমরা সম্মিলিতভাবে কাজ করতে প্রস্তুত।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, বিমানবন্দর অবকাঠামোর উন্নয়ন একটি বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া যেখানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
কক্সবাজার বিমানবন্দর এবং কার্গো ভিলেজ প্রকল্প
আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পায় কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্প এবং ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কার্গো ভিলেজের কার্যক্রম। কক্সবাজারকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন হাব হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সেখানে একটি আধুনিক বিমানবন্দর নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি। ইতোমধ্যে সেখানে রানওয়ে সম্প্রসারণ, টার্মিনাল নির্মাণ এবং এয়ার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উন্নয়ন কাজ শুরু হয়েছে।
অন্যদিকে, কার্গো ভিলেজ প্রকল্প বাংলাদেশের রপ্তানি খাতকে গতিশীল করার একটি অন্যতম উদ্যোগ। এই ভিলেজ চালু হলে তাজা খাদ্যপণ্য, পোশাক ও ওষুধ শিল্পসহ বিভিন্ন খাতের পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ সহজতর হবে। এধরনের প্রকল্পে কানাডার বিনিয়োগ অংশীদারত্ব সম্ভাব্য রপ্তানি বৃদ্ধির নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদি সম্প্রসারণ পরিকল্পনা এবং দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা
বেবিচক জানায়, সংস্থাটি দীর্ঘমেয়াদে একটি সমন্বিত সম্প্রসারণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করছে, যার আওতায় দেশের সব আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে আধুনিকীকরণ, যাত্রীসেবা উন্নয়ন এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হবে। এ ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ যেমন অর্থায়নের সমস্যা সমাধানে সহায়ক হতে পারে, তেমনি আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতেও অবদান রাখবে।
কানাডা ও বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে এবং বাণিজ্যিক সহযোগিতাও দিনে দিনে বাড়ছে। বিমান চলাচল সংক্রান্ত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ও সহযোগিতা এই সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করতে পারে। হাইকমিশনার অজিত সিংও এই বিষয়ে একমত প্রকাশ করেন এবং কানাডা সরকার ঢাকায় তাদের উপস্থিতি আরও জোরদার করতে আগ্রহী বলেও জানান।
বৈঠকে উপস্থিত কর্মকর্তারা
এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বেবিচকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এবং কানাডিয়ান হাই কমিশনের প্রতিনিধি দল উপস্থিত ছিলেন। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল বিনিয়োগ কাঠামো, সম্ভাব্য অর্থায়নের উৎস, প্রযুক্তিগত সহযোগিতা এবং দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারিত্বের সুযোগ।
এই বৈঠককে ঘিরে বিমান পরিবহন খাতে ভবিষ্যত সহযোগিতার একটি ভিত্তি তৈরি হলো। বাংলাদেশের পক্ষে এটি একটি কৌশলগত সুযোগ, যেখানে উন্নয়ন ও অগ্রগতির হাতিয়ার হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে কাজে লাগানো সম্ভব।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা ও চ্যালেঞ্জ
যদিও বিনিয়োগ আগ্রহ একটি ইতিবাচক সূচনা, তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে রয়েছে একাধিক চ্যালেঞ্জ। যেমন—জমি অধিগ্রহণ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, প্রকল্প ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা। তবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার ইতোমধ্যেই বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদেশি বিনিয়োগ শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই নয়, বরং জবাবদিহিতা ও ব্যবস্থাপনার গুণগত মান উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কানাডার মতো দেশের অংশগ্রহণ সেই দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
উপসংহার
বাংলাদেশের বিমান পরিবহন খাত এক নতুন যুগে প্রবেশ করতে চলেছে। এই খাতে কানাডার বিনিয়োগ আগ্রহ দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সংযোগকে আরও শক্তিশালী করবে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, রপ্তানি সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে এমন অংশীদারিত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
যদি আলোচ্য প্রস্তাবগুলি বাস্তব রূপ লাভ করে, তাহলে এটি বাংলাদেশ-কানাডা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করবে এবং দেশের বিমান পরিবহন খাতকে এগিয়ে নেবে একটি টেকসই ও প্রতিযোগিতামূলক ভবিষ্যতের দিকে।