অর্থনীতি

দুই লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট অনুমোদন

বাংলাদেশের আগামী অর্থবছর ২০২৫-২৬ সালের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) হিসেবে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বিশাল বাজেট অনুমোদন দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। এই বাজেট দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের রূপকল্প বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ নতুন বাজেটে ১৪ হাজার কোটি টাকার বৃদ্ধি ঘটেছে।

নতুন এডিপিতে মোট ১,১৪২টি প্রকল্পের জন্য ২ লাখ ১৫ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা আসবে সরকারি তহবিল থেকে এবং ৮৬ হাজার কোটি টাকা আসবে বৈদেশিক সহায়তা তথা ঋণের মাধ্যমে।

পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ

বরাবরের মতো এবারের বাজেটেও সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাত। এই খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫৮ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ২৫.৬৪ শতাংশ। দেশের মহাসড়ক, রেলপথ, মেট্রোরেল, নদীপথ ও বন্দর উন্নয়নে এই অর্থ ব্যয় হবে।

ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশালসহ প্রধান শহরগুলোতে চলমান অবকাঠামো প্রকল্প যেমন- মেট্রোরেল, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (BRT), এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ এগিয়ে নিতে এই বরাদ্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বড় বরাদ্দ

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩২ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা, যা মোট এডিপির ১৪.০৮ শতাংশ। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের সম্প্রসারণে এই বরাদ্দ ব্যয় হবে।

বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং সৌর ও বায়ু শক্তি উৎপাদন প্রকল্পগুলোতে এই অর্থ বিনিয়োগ করা হবে।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গৃহায়নে উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ

  • শিক্ষা খাত: ২৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা (১২.৪২%)। নতুন স্কুল-কলেজ নির্মাণ, আইসিটি শিক্ষা সম্প্রসারণ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে এই বরাদ্দ ব্যয় হবে।
  • গৃহায়ন ও কমিউনিটি সুবিধা: ২২ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা (৯.৯০%)। এতে শহরাঞ্চলের আবাসন প্রকল্প, পানির সরবরাহ, স্যানিটেশন এবং নগর পরিকল্পনার উন্নয়ন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
  • স্বাস্থ্য খাত: ১৮ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা (৭.৮৯%)। সরকারি হাসপাতালের অবকাঠামো, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও জনস্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে এই বরাদ্দ ব্যবহার হবে।

অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতের বরাদ্দ

খাতবরাদ্দ (কোটি টাকা)
স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন১৩,৪৭২
কৃষি খাত১০,৭৯৫
পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও পানিসম্পদ১০,৬৪১
শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা৫,০৩৮
বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি৩,৮৯৪
ধর্ম, সংস্কৃতি ও বিনোদন৩,৬৭৫
জনশৃঙ্খলা ও সুরক্ষা২,৭৭৭
সামাজিক সুরক্ষা২,০১৮
সাধারণ সরকারি সেবা১,৮৭৭
প্রতিরক্ষা৪৭৫

এই তালিকা থেকে স্পষ্ট যে, সরকার শুধুমাত্র অবকাঠামো উন্নয়ন নয়, বরং মানবিক উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণকেও সমান গুরুত্ব দিচ্ছে।

বাজেট কাঠামো ও বৈদেশিক সহায়তা

২০২৫-২৬ সালের এই উন্নয়ন বাজেটের ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা আসবে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে, যা আগের বছরের মূল এডিপির (১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা) তুলনায় ২১ হাজার কোটি টাকা কম। বৈদেশিক সহায়তার লক্ষ্যমাত্রাও কমিয়ে ১ লাখ কোটি টাকা থেকে ৮৬ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত দেশের রাজস্ব ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ এবং বৈদেশিক ঋণ নির্ভরতা কমানোর একটি সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ।

পূর্ববর্তী বাজেটের তুলনামূলক বিশ্লেষণ

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রাথমিক এডিপি ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। তবে বছর শেষে তা সংশোধন করে ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। নতুন এডিপি সেই সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা বেশি হলেও আগের বছরের মূল বাজেট থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা কম।

অর্থনীতিবিদদের মতে, এই সংকোচন একদিকে যেমন অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাবে, তেমনি বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্পগুলোর দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া যাবে।

পরিকল্পনা কমিশনের লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি

পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উন্নয়ন বাজেট প্রণয়নের সময় কয়েকটি মূলনীতি অনুসরণ করা হয়েছে:

  • বাস্তবায়নযোগ্য ও ফলপ্রসূ প্রকল্পকে অগ্রাধিকার
  • অপ্রয়োজনীয় ও দীর্ঘসূত্রতা প্রকল্প বাদ দেওয়া
  • বিদ্যমান অবকাঠামোর রক্ষণাবেক্ষণ ও মানোন্নয়নে জোর
  • জেলাভিত্তিক উন্নয়ন প্রকল্পে সমতা নিশ্চিত

তারা আরও বলেন, ‘‘সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই বাজেট বাস্তবমুখী করা হয়েছে।’’

চ্যালেঞ্জ ও সুপারিশ

তবে বাজেট বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো:

  • প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা
  • ব্যয় বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি
  • দক্ষ জনবল ও প্রকৌশলীর অভাব
  • অর্থ ছাড়ের ধীর গতি

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তবায়নক্ষমতা বাড়াতে প্রকল্প পরিকল্পনা ও তদারকি ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। তদারকির ঘাটতি থাকলে এই বরাদ্দও কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন বয়ে আনবে না।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেট দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বরাদ্দের দিক থেকে দেখা যাচ্ছে, সরকার অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ভারসাম্য বজায় রেখে বিনিয়োগ করছে। তবে কার্যকর বাস্তবায়নই হবে এই বাজেটের মূল চাবিকাঠি।

যদি যথাযথ পরিকল্পনা ও তদারকির মাধ্যমে এই বাজেট বাস্তবায়ন হয়, তাহলে এটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং নাগরিক জীবনের মানোন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button