অর্থনীতি

স্থলবন্দর বন্ধে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারতই

বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন পণ্য স্থলবন্দর দিয়ে আমদানির ওপর ভারতের সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে বাণিজ্য মহলে। তবে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের মতে, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে ভারতের ব্যবসায়ীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, কারণ ভারতের রফতানি নির্ভরতা বাংলাদেশের ওপর বেশি।

রোববার (১৮ মে) সচিবালয়ে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, “আমি এখনও অফিসিয়ালি কোনো নিষেধাজ্ঞার কাগজ হাতে পাইনি। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ বিষয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। কিছু তথ্য চাওয়া হয়েছে, সেগুলো পেলে আমরা বিস্তারিত জানতে পারবো।”

তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বাণিজ্যে দুই দেশেরই ভোক্তা ও ব্যবসায়ী অংশগ্রহণ করে। কিন্তু ভারতে উৎপাদিত যেসব পণ্য বাংলাদেশে আসে, তার পরিমাণ অনেক বেশি। ফলে স্থলবন্দর বন্ধ হলে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতীয় ব্যবসায়ীদেরই ক্ষতি হবে বেশি।”

নিষেধাজ্ঞা কোন কোন পণ্যে?

ভারত ইতিমধ্যে বাংলাদেশ থেকে ফল, তৈরি পোশাক, সিরামিকস, ডিটারজেন্ট, কসমেটিকস, স্যান্ডেলসহ অন্তত সাত ধরনের পণ্যের স্থলপথে আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এখন শুধু কলকাতা ও মুম্বাই সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে এসব পণ্য ভারতে পাঠানো যাবে।

এই সিদ্ধান্ত এসেছে ঠিক এক মাস পর, যখন বাংলাদেশ ভারত থেকে সুতা আমদানির ওপর সীমিত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। এর জবাবে ভারতও নিজেদের স্থলবন্দর সীমাবদ্ধ করার পদক্ষেপ নিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বাণিজ্য ঘাটতির বাস্তবতা

বর্তমানে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ভারসাম্য রয়েছে ভারতের পক্ষে। প্রতি বছর ভারত থেকে প্রায় ১৩-১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য বাংলাদেশে আসে, বিপরীতে বাংলাদেশ রফতানি করে মাত্র ১.৫ থেকে ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। তাই স্থলবন্দর বন্ধ হলে রফতানির পরিমাণ বেশি হওয়ায় ভারতেরই বেশি লোকসান হবে।

বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, “আমাদের বাণিজ্য সক্ষমতা বাড়ানোর দিকেই গুরুত্ব দিচ্ছি। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে, এ ধরনের সমস্যার সমাধান আলোচনার মাধ্যমেই সম্ভব।”

বিকল্প রপ্তানি বাজার খোঁজার তাগিদ

বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিবেশী ভারতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এখন ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য বাংলাদেশের উচিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় রপ্তানির নতুন বাজার তৈরি করা।

এ বিষয়ে এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরোর সাবেক কর্মকর্তা বলেন, “ভারতের বাজার বড় হলেও তাদের আমদানিনীতির হঠাৎ পরিবর্তন আমাদের জন্য ধাক্কা হয়ে দাঁড়ায়। তাই বিকল্প বাজার খুঁজে বের করাটা এখন সময়ের দাবি।”

সংকট সমাধানে কূটনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন

এই নিষেধাজ্ঞা যদি সরকারি পর্যায়ে নিশ্চিত হয়, তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ কূটনৈতিক উদ্যোগে তা সমাধান করতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এক অধ্যাপক বলেন, “এই সংকট শুধু অর্থনৈতিক নয়, কূটনৈতিকও। বিষয়টি পারস্পরিক আস্থার বিষয়। দীর্ঘমেয়াদে দুই দেশই এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভারত যদি আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য কমিয়ে দেয়, তা হলে সেটি প্রতিবেশী সম্পর্কের জন্যও শুভ হবে না।”

স্থলবন্দর বন্ধের এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র অর্থনীতির পরিসংখ্যান নয়, বরং দুই দেশের মধ্যকার আস্থার সংকেতও বহন করে। ভারত যদি স্থলপথে পণ্য গ্রহণ না করে, তবে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের লজিস্টিক খরচ অনেক বেড়ে যাবে এবং পণ্য পৌঁছাতে সময়ও লাগবে বেশি। তবে বড় ক্ষতির আশঙ্কা ভারতের ব্যবসায়ীদেরই, যারা বাংলাদেশকে বড় বাজার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button