গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ভারতীয় ইউটিউবার জ্যোতি মালহোত্রা গ্রেফতার

পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ভারতের জনপ্রিয় ইউটিউবার জ্যোতি মালহোত্রাকে গ্রেফতার করেছে হরিয়ানা পুলিশ। শনিবার (১৭ মে) ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া এই খবর নিশ্চিত করেছে। জ্যোতি, যিনি ‘ট্র্যাভেল উইথ জো’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল পরিচালনা করেন, তার বিরুদ্ধে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সংবেদনশীল তথ্য পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের কাছে পাচারের অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে।
হরিয়ানার হিসার জেলার বাসিন্দা জ্যোতি মালহোত্রাকে শনিবার তাঁর নিজ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর তাঁকে আদালতে হাজির করা হলে পাঁচ দিনের পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। পুলিশের অভিযোগ, জ্যোতি পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন এবং হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম ও স্ন্যাপচ্যাটের মতো এনক্রিপ্টেড প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সংবেদনশীল তথ্য পাচার করতেন। তাঁর বিরুদ্ধে ১৯২৩ সালের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ধারা ৩, ৪ ও ৫ এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির (বিএনএস) ধারা ১৫২-এর অধীনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
গুপ্তচরবৃত্তির শুরু: পাকিস্তান সফর ও সম্পর্ক
তদন্তকারীদের মতে, জ্যোতি ২০২৩ সালে ভিসা এজেন্টের মাধ্যমে দুইবার পাকিস্তান ভ্রমণ করেন। এই সফরের সময় তিনি নয়াদিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মকর্তা এহসান-উর-রহিম ওরফে দানিশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। দানিশ তাঁকে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্টদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এই এজেন্টদের মধ্যে ছিলেন আলী আহসান এবং শাকির ওরফে রানা শাহবাজ। সন্দেহ এড়াতে জ্যোতি শাহবাজের মোবাইল নম্বর তাঁর ফোনে ‘জাট রানধাওয়া’ নামে সেভ করেছিলেন।
তদন্তে আরও জানা গেছে, জ্যোতি একজন পাকিস্তানি গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। সম্প্রতি তাঁরা ইন্দোনেশিয়ার বালিতে একসঙ্গে ভ্রমণ করেছিলেন। এই সম্পর্কের সুবাদে জ্যোতি পাকিস্তানের পক্ষে সোশ্যাল মিডিয়ায় ইতিবাচক প্রচার চালাতেন এবং ভারতের বিরুদ্ধে প্রচারণায় অংশ নিতেন। তাঁর ইউটিউব চ্যানেল ‘ট্র্যাভেল উইথ জো’-তে প্রায় ৩.৭৭ লাখ সাবস্ক্রাইবার রয়েছে, যেখানে তিনি পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানের ভ্রমণ ভিডিও পোস্ট করতেন। এই ভিডিওগুলোতে পাকিস্তানের সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার প্রশংসা করা হতো।
গুপ্তচর নেটওয়ার্কের উন্মোচন
জ্যোতির গ্রেফতারের মাধ্যমে হরিয়ানা ও পাঞ্জাব জুড়ে বিস্তৃত একটি গুপ্তচর নেটওয়ার্কের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই মামলায় এখন পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে রয়েছেন পাঞ্জাবের মালেরকোটলার ৩২ বছর বয়সী ঘাজালা, যিনি দানিশের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনে জড়িত ছিলেন এবং ভিসা সংক্রান্ত কাজে সহায়তা করতেন। এছাড়া, ইয়ামিন মোহাম্মদ নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যিনি দানিশের জন্য হাওলা ও অন্যান্য পদ্ধতিতে অর্থ পাঠাতেন। হরিয়ানার কৈথলের দেবিন্দর সিং ধিলন পাকিস্তান সফরের সময় পাতিয়ালা ক্যান্টনমেন্টের ভিডিও পাকিস্তানি এজেন্টদের কাছে পাঠিয়েছিলেন। হরিয়ানার নুহ থেকে গ্রেফতার আরমান নামে এক যুবক ভারতীয় স iskIM কার্ড সরবরাহ করতেন এবং ডিফেন্স এক্সপো ২০২৫-এর স্থান পরিদর্শন করেছিলেন।
পুলিশ জানিয়েছে, এই নেটওয়ার্কের সদস্যরা মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের জন্য কাজ করতেন। তদন্তে জানা গেছে, জ্যোতি ছাড়াও এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা ভারতের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটি ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত তথ্য পাকিস্তানের কাছে পাচার করতেন।
আইনি পদক্ষেপ ও তদন্ত
জ্যোতি মালহোত্রা নিজের দোষ স্বীকার করেছেন এবং পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদানের বিষয়টি মেনে নিয়েছেন। তাঁর লিখিত স্বীকারোক্তি রেকর্ড করা হয়েছে। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হিসার পুলিশের অর্থনৈতিক অপরাধ শাখার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। হিসার পুলিশের মুখপাত্র বিকাশ কুমার জানিয়েছেন, “অভিযুক্তকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে এবং তদন্তের স্বার্থে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।”
ভারত সরকার গত ১৩ মে পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মকর্তা দানিশকে ‘অবাঞ্ছিত ব্যক্তি’ ঘোষণা করে দেশ ত্যাগের নির্দেশ দেয়। তবে, জ্যোতি এরপরও দানিশের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছিলেন। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, অভিযুক্তদের ফোন ও ডিজিটাল ডিভাইস পরীক্ষা করে তাঁদের যোগাযোগের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে প্রভাব
এই ঘটনা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনাকে আরও তীব্র করেছে। সম্প্রতি পহেলগামে জঙ্গি হামলার পর ভারত ‘অপারেশন সিন্দুর’ চালিয়ে পাকিস্তানের জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করেছে। এই প্রেক্ষাপটে গুপ্তচরবৃত্তির এই ঘটনা দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এটি যুদ্ধবিরতি চলাকালীন তৃতীয় গ্রেফতারের ঘটনা।
সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা
জ্যোতির গ্রেফতারের ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব ও এর অপব্যবহার নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। তাঁর ইউটিউব ও ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে পাকিস্তানের প্রশংসামূলক পোস্ট এবং ভিডিও ছিল, যা পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ভারতের বিরুদ্ধে প্রচারণার জন্য ব্যবহার করত। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, জ্যোতির সোশ্যাল মিডিয়া উপস্থিতি পাকিস্তানের জন্য একটি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছিল।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া
জ্যোতির গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকে তাঁর এই কার্যকলাপে হতাশা প্রকাশ করেছেন। এক্স-এ পোস্টে টাইমস নাও জানিয়েছে, “জ্যোতি মালহোত্রার পাকিস্তান সংযোগ তদন্তের আওতায়। তিনি পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।” ইন্ডিয়া টুডে জানিয়েছে, “এই ঘটনায় হানিট্র্যাপের সম্ভাবনাও তদন্ত করা হচ্ছে।”
উপসংহার
জ্যোতি মালহোত্রার গ্রেফতারের ঘটনা কেবল একজন ইউটিউবারের অপরাধের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি বৃহত্তর গুপ্তচর নেটওয়ার্কের উন্মোচন করেছে। এই ঘটনা ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। তদন্ত এখনও চলছে, এবং আগামী দিনে এই মামলায় আরও তথ্য প্রকাশ পেতে পারে।