বানিজ্য

রাশিয়া আবার সস্তা গম আমদানির বড় উৎস

বাংলাদেশে সস্তা গমের প্রধান উৎস হিসেবে আবারও রাশিয়া উঠে এসেছে সামনে। কৃষ্ণসাগর অঞ্চলভুক্ত দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে বহুদিন ধরে বাংলাদেশ গম আমদানি করে আসছিল। কিন্তু ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই আমদানি ব্যাহত হয়। তখন ভারতের পাশাপাশি কানাডাও গম আমদানির বিকল্প উৎস হিসেবে গুরুত্ব পায়। তবে এখন পরিস্থিতি বদলেছে। আবারও আমদানিকারকেরা গমের সস্তা উৎস হিসেবে রাশিয়ার প্রতি ঝুঁকছেন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) বাংলাদেশে গম আমদানি হয়েছে প্রায় ৪৯ লাখ টন। এর মধ্যে ৫৪ শতাংশ গম এসেছে রাশিয়া থেকে, যার জন্য ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭০ কোটি মার্কিন ডলার। এর আগে সর্বোচ্চ রাশিয়া থেকে গম আমদানি হয় ২০০৬–০৭ অর্থবছরে, যখন মোট আমদানির ৫৭ শতাংশ এসেছিল রাশিয়া থেকে।

ইউক্রেন থেকে আমদানি হ্রাস

যুদ্ধের আগে ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশ বছরে গড়ে ২৩ থেকে ৩০ শতাংশ গম আমদানি করত। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ইউক্রেন থেকে আমদানির হার নেমে এসেছে মাত্র ১৪ শতাংশে। যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থার কারণে ইউক্রেনের গম রপ্তানি সক্ষমতা কমে যাওয়ায় বাংলাদেশে রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা বাড়ছে।

কেন বাড়ছে রাশিয়া থেকে আমদানি?

আমদানিকারকেরা বলছেন, রাশিয়া থেকে গম আমদানির মূল কারণ হলো তুলনামূলকভাবে কম দাম ও সহজলভ্যতা। গত এপ্রিল মাসে রাশিয়া থেকে গম আমদানির খরচ পড়েছে টনপ্রতি ২৫১ থেকে ২৬১ ডলার, যা কেজিপ্রতি ৩১ থেকে ৩২ টাকা। অন্যদিকে, কানাডা থেকে উচ্চ আমিষযুক্ত গম আমদানির খরচ হয়েছে টনপ্রতি ২৯৮ থেকে ৩৩০ ডলার, অর্থাৎ কেজিপ্রতি ৩৬ থেকে ৪০ টাকা।

আমদানিতে বৈচিত্র্য বাড়ানোর আহ্বান

যদিও দাম ও সরবরাহ সুবিধাজনক হলেও শুধুমাত্র একটি দেশের ওপর নির্ভরতা ব্যবসা ও বাজারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। ডেল্টা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেন, ‘‘রাশিয়া থেকে আমদানি সহজ হলেও কখনো কখনো ব্যাংকিং জটিলতা দেখা দেয়। খাদ্যশস্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও, একক উৎসের ওপর নির্ভরশীলতা বিপদজনক। তাই বহুমুখী উৎস থেকে আমদানি করা উচিত।’’

বর্তমানে ব্রাজিল থেকেও সীমিত পরিমাণে গম আমদানি শুরু হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ব্রাজিল থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার টন গম এসেছে, যা মোট আমদানির মাত্র ২ শতাংশ।

গমের ধরন অনুযায়ী আমদানি

বাংলাদেশে দুই ধরনের গম আমদানি করা হয়। একদিকে, কম আমিষযুক্ত গম, যা কেক, বিস্কুট ও অন্যান্য বেকারিপণ্যে ব্যবহৃত হয়। এটি সাধারণত কৃষ্ণসাগর অঞ্চল ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো থেকে আমদানি করা হয়। অন্যদিকে, উচ্চ আমিষযুক্ত গম, যা পরোটা, পাস্তা, নুডলস ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়, আমদানি করা হয় কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

বর্তমানে গম আমদানির ক্ষেত্রে উচ্চ আমিষযুক্ত গমের পরিমাণ কমে এসেছে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে আমদানিকৃত গমের মাত্র ১৮ শতাংশ ছিল উচ্চ আমিষযুক্ত, বাকি ৮২ শতাংশই ছিল সাধারণ মানের গম। অথচ কয়েক বছর আগেও উচ্চ আমিষযুক্ত গমের আমদানি ছিল ৩০ শতাংশের কাছাকাছি।

অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও বৈদেশিক ব্যয়

বাংলাদেশে গমের মোট চাহিদার মাত্র ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়। বাকি ৮৫ শতাংশই আমদানি করতে হয় বৈদেশিক উৎস থেকে। এক দশক আগে যেখানে গম আমদানিতে ব্যয় হতো ১০০ কোটি ডলার, বর্তমানে তা দ্বিগুণ হয়ে ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে গম আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল ২০৫ কোটি ডলার, আর চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসেই ব্যয় হয়েছে ১৩৪ কোটি ডলার।

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও প্রস্তুতি

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বৈশ্বিক বাজারে খাদ্যশস্যের দাম ওঠানামা করে, আর যুদ্ধ বা রাজনৈতিক টানাপোড়েন থাকলে সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। তাই সস্তা হলেও একক উৎসের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। বর্তমানে রাশিয়া বড় যোগানদাতা হলেও, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলের মতো দেশগুলো থেকে আমদানির পরিমাণ বাড়ানোর পরিকল্পনা থাকা উচিত।

পরিশেষে বলা যায়, খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে আমদানিতে বৈচিত্র্য আনা ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর উপর গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু সস্তা গম নয়, গুণগত মান, নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও বিবেচনায় নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button