চীনের ঘোষণা রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বাড়ানো হবে

চীন ও রাশিয়ার মধ্যকার কৌশলগত ও সামরিক সম্পর্ক আরও গভীর করার ঘোষণা দিয়েছে বেইজিং। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৮০তম বিজয় দিবস উপলক্ষে রাশিয়ার রাজধানী মস্কো সফর শেষে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এ ঘোষণা দেন। এ সফরের অংশ হিসেবে তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করেন এবং ঐতিহাসিক কুচকাওয়াজে অংশ নেন। এই ঘনিষ্ঠতা শুধু দুই দেশের মধ্যকার সামরিক সম্পর্ককেই জোরদার করবে না, বরং বৈশ্বিক রাজনীতিতে একটি নতুন মেরুকরণের আশঙ্কাও বাড়িয়ে তুলেছে।
বৃহস্পতিবার (১৫ মে) প্রকাশিত তাস নিউজ ও আরব নিউজের বরাতে জানা গেছে, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও পুতিনের বৈঠকে সামরিক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি আদান-প্রদান এবং যৌথ মহড়াসহ নানা ব্যবহারিক সামরিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠক শেষে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ‘চীন ও রাশিয়ার মধ্যকার কৌশলগত অংশীদারিত্ব অটুট ও দৃঢ়। উভয় দেশ বহুমুখী ব্যবহারিক সহযোগিতার মাধ্যমে বিশ্বে স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্য রক্ষায় অবদান রাখতে বদ্ধপরিকর।’
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন মাত্রা
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউক্রেন সংকট শুরুর পর থেকেই রাশিয়া আন্তর্জাতিকভাবে অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রাশিয়ার কৌশলগত অবস্থানকে নতুন করে শক্তিশালী করছে। চীনও এই সম্পর্কের মাধ্যমে তার বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রভাব ও ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে সুনিশ্চিত করতে চায়। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের চাপ মোকাবেলায় এই দুই পরাশক্তির একযোগে কাজ করা ভবিষ্যতের বৈশ্বিক কূটনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।
চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমগুলো এই সফরকে একটি ‘ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের নিদর্শন’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। চীনা প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমরা আমাদের সামরিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার করব এবং কৌশলগত সমন্বয় আরও গভীর করব। বিশ্বে ন্যায়বিচার ও আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা রক্ষায় আমাদের ভূমিকা অব্যাহত থাকবে।’
পশ্চিমা বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি
তবে এই সম্পর্ক নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়াকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন করার অভিযোগ রয়েছে চীনের বিরুদ্ধে। পশ্চিমা জোটের দাবি, চীন রাশিয়াকে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী করতে ভূমিকা রাখছে। যদিও বেইজিং এসব অভিযোগ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানিয়েছেন, ‘চীন সব সময় শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে এবং আমরা যুদ্ধ বন্ধে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছি। চীন কখনোই একতরফা নিষেধাজ্ঞা বা সামরিক সমর্থনের পক্ষে নয়।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি ও ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা নিরসনে চীনের কূটনৈতিক ভূমিকা যতই জোরালো হোক না কেন, রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক বজায় রাখার কারণে চীনের নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই থাকবে।
তাইওয়ান ও পূর্ব এশিয়ায় উত্তেজনার প্রভাব
চীন-রাশিয়ার এই সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির খবর এমন সময়ে এসেছে যখন তাইওয়ানকে ঘিরেও পূর্ব এশিয়ায় উত্তেজনা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সামরিক ও কৌশলগত সহায়তায় তাইওয়ান বর্তমানে তার প্রতিরক্ষা সক্ষমতা জোরদার করছে। বেইজিং দীর্ঘদিন ধরে তাইওয়ানকে চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি করে আসছে এবং ভবিষ্যতে সামরিক শক্তির মাধ্যমে তা পুনঃদখলের হুমকিও দিয়ে আসছে।
এই প্রেক্ষাপটে চীন যদি রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সামরিক জোট গড়ে তোলে, তবে তা শুধু ইউক্রেন সংকটেই নয়, বরং পূর্ব এশিয়াতেও উত্তেজনা আরও তীব্র করে তুলতে পারে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরনের জোট আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্ককে জটিল ও অনিশ্চিত করে তুলতে পারে।
নতুন বৈশ্বিক কৌশলগত কাঠামোর সূচনা?
বিশ্ব রাজনীতিতে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বিশেষ করে পশ্চিমা জোট ও চীন-রাশিয়ার মেরুকরণ এক ধরনের নতুন স্নায়ুযুদ্ধের আভাস দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো জোট একদিকে যেমন ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে, অন্যদিকে চীন-রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা এই ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি নতুন কৌশলগত কাঠামো গড়ে উঠতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
চীন ও রাশিয়ার যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তারা বিশ্বের একমেরু আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চায় এবং একটি ‘বহুমেরু’ ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পক্ষে। তাদের মতে, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় পশ্চিমা আধিপত্য বৈষম্য সৃষ্টি করছে এবং এর ফলে অনেক রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে।
সমাপ্তি
চীন ও রাশিয়ার মধ্যকার সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক নতুন বাস্তবতার সূচনা করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ, তাইওয়ান সংকট এবং পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে দ্বন্দ্বপূর্ণ সম্পর্কের পটভূমিতে এই ঘনিষ্ঠতা শুধু কৌশলগত নয়, বরং ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশকেও আমূল বদলে দিতে পারে। এই নতুন বাস্তবতায় বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর আচরণ এবং কৌশলগত অবস্থান কতটা রূপান্তরিত হয়, তা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।