অর্থনীতি

ডলারের দাম এখন থেকে ঠিক করবে ‘বাজার’: গভর্নর

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ঘোষণা করেছেন, মার্কিন ডলারের বিনিময় হার এখন থেকে বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নির্ভর করে নির্ধারিত হবে। বুধবার (১৪ মে ২০২৫) বাংলাদেশ ব্যাংকের আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দুবাই থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এ ঘোষণা দেন। এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশের অর্থনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো, যা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচির শর্ত পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। গভর্নর জানান, বর্তমান বিনিময় হারের আশপাশেই ডলারের দাম থাকবে, তবে বাজারের গতিশীলতার ওপর ভিত্তি করে এটি সামান্য হ্রাস-বৃদ্ধি পেতে পারে।

বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের পটভূমি

বাংলাদেশের অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের ওপর নির্ভরশীল ছিল। তবে, আইএমএফের সঙ্গে চলমান ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার শর্ত ছিল অন্যতম। গত কয়েক মাস ধরে আইএমএফের সঙ্গে এ বিষয়ে দর-কষাকষি চলছিল। আইএমএফের দাবি ছিল, বিনিময় হারে আরও নমনীয়তা আনা না হলে ঋণের পরবর্তী কিস্তি ছাড় করা সম্ভব হবে না। এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি বিনিময় হারে নমনীয়তা আনার সিদ্ধান্ত নেয়, যার ফলে আইএমএফ দুটি কিস্তি একসঙ্গে ছাড় করতে সম্মত হয়েছে। এই কিস্তিগুলোর মোট মূল্য প্রায় ১৩৩ কোটি ডলার, যা আগামী জুনের মধ্যে পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার জন্য এখনই উপযুক্ত সময়। প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল হচ্ছে, এবং লেনদেন ভারসাম্যে উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আগামী জুনের মধ্যে ৩৫০ কোটি ডলার আসবে, যা আমাদের রিজার্ভকে আরও শক্তিশালী করবে।” তিনি আরও জানান, গত নয় মাসে রিজার্ভ থেকে কোনো ডলার বিক্রি করা হয়নি, এবং বিনিময় হার স্থিতিশীল রয়েছে। এই স্থিতিশীলতার কারণেই বাজারভিত্তিক বিনিময় হারে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের প্রভাব

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের ফলে ডলারের দাম এখন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। বর্তমানে ডলারের দাম প্রতি ইউনিটে ১২২ টাকার আশপাশে রয়েছে। গভর্নর জানিয়েছেন, নতুন ব্যবস্থায় দাম হঠাৎ করে ১৪০-১৫০ টাকায় পৌঁছানোর কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। তবে, বাজারের অস্থিরতা রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক থাকবে এবং প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেবে। তিনি দুবাইয়ের কিছু সিন্ডিকেট কোম্পানির বাজার অস্থিতিশীল করার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে বলেন, “আমরা সার্বক্ষণিক তদারকি করব এবং অনৈতিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব।”

বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলোকে বাজারভিত্তিক দামে লেনদেন শুরু করার নির্দেশ দিয়েছে। তবে, দামের সঙ্গে বড় ধরনের পার্থক্য যেন না হয়, সেদিকে নজর রাখতে বলা হয়েছে। এই ব্যবস্থায় ব্যাংকগুলো বাজারের চাহিদার ভিত্তিতে ডলারের দাম নির্ধারণ করবে, যা অর্থনীতির স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

আইএমএফ ঋণ এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা

আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদনের পর বাংলাদেশ এ পর্যন্ত তিনটি কিস্তি পেয়েছে। তবে, চতুর্থ কিস্তির ক্ষেত্রে বিনিময় হার নিয়ে আলোচনার কারণে বিলম্ব হয়। গত এপ্রিল ও মে মাসে আইএমএফের সঙ্গে একাধিক বৈঠকের পর বাংলাদেশ বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার প্রতিশ্রুতি দেয়, যার ফলে আইএমএফ দুটি কিস্তি ছাড় করতে সম্মত হয়। এই অর্থ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা জোরদার করবে।

গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, “আমাদের রিজার্ভ বর্তমানে ২৪.৯৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। নতুন ঋণের অর্থ আসার পর এটি আরও বাড়বে।” তিনি জানান, গত দুই মাসে জ্বালানি ও অত্যাবশ্যকীয় সেবার বকেয়া ১৮০ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছে, যা অর্থনীতির ওপর চাপ কমাবে। তবে, তিনি দেশের ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক ঋণ (১০৩ বিলিয়ন ডলার) নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কমপক্ষে এক বছর সময় লাগবে বলে জানান।

অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত

বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগে স্বচ্ছতা বাড়াবে এবং বাজারের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করবে। তবে, বাজার অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি এড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কঠোর তদারকি অব্যাহত রাখতে হবে। গভর্নর মনসুর এ বিষয়ে আশাবাদী এবং বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতি সঠিক পথে এগোচ্ছে। আমরা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

এই সিদ্ধান্তের ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রিজার্ভ বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে, যা দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button