পেট্রোল পাম্পের জায়গায় চার্জিং স্টেশন, আসছে ইভির যুগ

বিশ্বজুড়ে বৈদ্যুতিক যানবাহনের (ইভি) উত্থান জ্বালানি খাতে এক নাটকীয় পরিবর্তনের সূচনা করেছে। পেট্রোল পাম্পের জায়গা দখল করছে চার্জিং স্টেশন, আর তেলের ওপর নির্ভরতা ক্রমশ কমছে। আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা (আইইএ) জানিয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ইভি প্রতিদিন প্রায় ৫০ লক্ষ ব্যারেল তেলের ব্যবহার প্রতিস্থাপন করবে। এই বিপ্লবের কেন্দ্রে রয়েছে চীন, যার বাজার ও উৎপাদন কাঠামো বিশ্বব্যাপী ইভি শিল্পে আধিপত্য বিস্তার করছে।
বিশ্বব্যাপী ইভির উত্থান
২০২৪ সালে বিশ্ববাজারে ইভি বিক্রি পৌঁছেছে ১ কোটি ৭০ লক্ষে, যা ২০২০ সালের সম্পূর্ণ বাজারের সমান। আইইএর পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালে এই সংখ্যা ২ কোটিতে পৌঁছাবে, যা বৈশ্বিক গাড়ি বিক্রির এক-চতুর্থাংশেরও বেশি। এই দ্রুত বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে সাশ্রয়ী ব্যাটারি উৎপাদন, সরকারি নীতি, এবং ক্রমবর্ধমান পরিবেশ সচেতনতা।
চীন এই দৌড়ে অনেক এগিয়ে। ২০২৪ সালে দেশটি একাই ১ কোটি ১০ লক্ষ ইভি বিক্রি করেছে। চীনের ঘরোয়া বাজারে ইভির অংশীদারিত্ব এখন প্রায় ৫০ শতাংশ, যা ২০২৫ সালে ৬০ শতাংশ এবং ২০৩০ সালে ৮০ শতাংশে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। চীনের এই আধিপত্যের পেছনে রয়েছে সরকারি প্রণোদনা, বিশাল বিনিয়োগ, এবং ব্যাটারি উৎপাদনে অগ্রগতি।
ইউরোপও ইভি গ্রহণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখাচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ইউরোপে ইভি বিক্রি মোট গাড়ি বিক্রির ৬০ শতাংশে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কঠোর নির্গমন নিয়ন্ত্রণ এবং সরকারি ভর্তুকি এই প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও ইভির চাহিদা বাড়ছে। এই অঞ্চলে ২০৩০ সালে ইভি বিক্রি মোট বিক্রির ২৫ শতাংশে পৌঁছাবে, এবং দুই ও তিন চাকার ইভির ক্ষেত্রে এই হার হবে এক-তৃতীয়াংশ।
তবে যুক্তরাষ্ট্র এই দৌড়ে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। আইইএর পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ইভি বিক্রি সর্বোচ্চ ২০ শতাংশে পৌঁছাবে। উচ্চ দাম, অপর্যাপ্ত চার্জিং অবকাঠামো, এবং ভোক্তাদের মধ্যে তুলনামূলক কম সচেতনতা এর পেছনে প্রধান কারণ।
সৌদি আরবের ইভি উচ্চাভিলাষ
মধ্যপ্রাচ্যের তেল-নির্ভর অর্থনীতির দেশ সৌদি আরবও ইভি বিপ্লবে যোগ দিয়েছে। ‘ভিশ
ন ২০৩০’-এর অংশ হিসেবে সৌদি আরব রিয়াদে ৩০ শতাংশ যানবাহনকে বৈদ্যুতিক করার লক্ষ্য নিয়েছে। দেশটি নিজস্ব ইভি ব্র্যান্ড ‘সিয়ার’ চালু করেছে এবং আমেরিকান ইভি নির্মাতা লুসিড মোটরসে ৬১ শতাংশ মালিকানা অর্জন করেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ৫ লক্ষ ইভি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগোচ্ছে রাজ্যটি। এই উদ্যোগ তেল-নির্ভর অর্থনীতি থেকে বৈচিত্র্যময় অর্থনীতির দিকে সৌদি আরবের রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করবে।
ইভি বিপ্লবের পেছনে ব্যাটারি উৎপাদন
ইভির দ্রুত গ্রহণযোগ্যতার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হলো ব্যাটারি উৎপাদন খরচের উল্লেখযোগ্য হ্রাস। চীনে ব্যাটারির দাম গত কয়েক বছরে ৩০ শতাংশ কমেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে এই হ্রাস ১৫ শতাংশ পর্যন্ত। এই খরচ হ্রাস ইভিকে আরও সাশ্রয়ী করে তুলেছে, যা ভোক্তাদের কাছে এর আকর্ষণ বাড়িয়েছে।
চীন ব্যাটারি উৎপাদনে বিশ্ববাজারে প্রায় ৬০ শতাংশ অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। দেশটির কোম্পানিগুলো, যেমন সিএটিএল এবং বিওয়াইডি, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এবং কম খরচের ব্যাটারি উৎপাদনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই অগ্রগতি শুধু ইভির দামই কমায়নি, বরং বৈদ্যুতিক ট্রাক এবং বাসের মতো ভারী যানবাহনের ব্যবহারও বাড়িয়েছে।
ভারী যানবাহনে ইভির প্রভাব
ইভির প্রভাব শুধু হালকা যাত্রীবাহী গাড়ির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বৈদ্যুতিক ট্রাক এবং বাসের ব্যবহারও দ্রুত বাড়ছে। চীনে ব্যাটারি চালিত ট্রাক ইতোমধ্যেই খরচের দিক থেকে ডিজেল ট্রাকের সমান হয়ে গেছে। ২০২৪ সালে বৈদ্যুতিক ট্রাকের বিক্রি দ্বিগুণ হয়ে ৭৫ হাজারে পৌঁছেছে, যা বৈশ্বিক বাজারের ৮০ শতাংশ।
এই প্রবৃদ্ধি তেলের চাহিদা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আইইএর মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে ভারী যানবাহনে ইভির ব্যবহার তেলের চাহিদা আরও ১০ লক্ষ ব্যারেল কমাবে। এই পরিবর্তন পরিবহন খাতকে আরও টেকসই করে তুলছে এবং কার্বন নির্গমন হ্রাসে সহায়তা করছে।
পরিবেশ ও অর্থনৈতিক সুবিধা
বিশ্লেষকদের মতে, ইভি তিনটি কারণে ভবিষ্যতের পরিবহন ব্যবস্থার অবিসংবাদিত পছন্দ হবে: খরচ-সাশ্রয়ীতা, পরিবেশবান্ধবতা, এবং ভবিষ্যৎ-বান্ধবতা। ইভির রক্ষণাবেক্ষণ খরচ তুলনামূলক কম, এবং বিদ্যুৎ ব্যবহার তেলের তুলনায় সাশ্রয়ী। এছাড়া, ইভি কার্বন নির্গমন শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে আসে, যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ।
তেলের দামের ওঠানামা সত্ত্বেও ইভির চাহিদা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ছে, ইভির গ্রহণযোগ্যতা আরও ত্বরান্বিত হবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশেও ইভির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে, যদিও এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। সরকার বৈদ্যুতিক যানবাহনের জন্য কর হ্রাস এবং চার্জিং অবকাঠামো তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। তবে, অপর্যাপ্ত চার্জিং স্টেশন এবং উচ্চ আমদানি খরচ ইভি গ্রহণের পথে প্রধান বাধা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব এবং নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে বাংলাদেশও ইভি বিপ্লবে যোগ দিতে পারে।
উপসংহার
ইভির যুগ আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। পেট্রোল পাম্পের জায়গা দখল করছে চার্জিং স্টেশন, আর তেলের ওপর নির্ভরতা ক্রমশ অতীত হচ্ছে। চীনের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী ইভি বিপ্লব পরিবহন খাতকে নতুন রূপ দিচ্ছে। সৌদি আরবের মতো তেল-নির্ভর দেশ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ—সবাই এই পরিবর্তনের অংশ হচ্ছে। ইভি শুধু পরিবহনের মাধ্যম নয়, এটি একটি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব ভবিষ্যতের প্রতীক।