বানিজ্য

রাজশাহীতে এক বছরে ২৬.৯ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স

২০২৪ সালে রাজশাহী জেলায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারে, যা এ অঞ্চলের অর্থনীতির জন্য একটি রেকর্ড অর্জন। এই প্রবাহ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

আজ বুধবার রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে এই তথ্য তুলে ধরা হয়। ‘নিরাপদ অভিবাসন ও দক্ষতা উন্নয়ন’ শীর্ষক সেমিনারটি আয়োজন করে জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস। এতে সরকারি কর্মকর্তা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, নারী উদ্যোক্তা, মোটর শ্রমিক, ইজিবাইক সংগঠনের প্রতিনিধি ও গণমাধ্যমকর্মীরা অংশ নেন।

রেমিট্যান্সের প্রকৃত অবদান গার্মেন্টস খাতের চেয়েও বেশি

সেমিনারে আলোচকরা বলেন, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিসেবে গার্মেন্টস খাতকে চিহ্নিত করা হলেও প্রকৃত মুনাফার বিচারে রেমিট্যান্স তার চেয়ে অনেক এগিয়ে। কারণ গার্মেন্টস শিল্পে কাঁচামাল আমদানির বিপুল ব্যয় থাকলেও, রেমিট্যান্স সরাসরি নিট বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে জমা হয়। এক হিসেবে দেখা গেছে, গার্মেন্টস খাতের তুলনায় রেমিট্যান্স থেকে তিন গুণ বেশি নিট বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে।

বর্তমানে বিশ্বের ১৭৩টি দেশে বসবাসরত প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ প্রবাসী বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনন্য ভূমিকা রাখছেন। রাজশাহী অঞ্চলে কর্মরত অধিকাংশ প্রবাসী মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক হলেও ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও তাদের উপস্থিতি রয়েছে।

অদক্ষ কর্মীর হার ৪৭%, দক্ষতা বাড়াতে সরকারি পদক্ষেপ

কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের সহকারী পরিচালক আতিকুর রহমান সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি জানান, বর্তমানে বিদেশে পাঠানো কর্মীদের মধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ অদক্ষ। আধা-দক্ষ কর্মীর হার ১৬ শতাংশ এবং দক্ষ কর্মী মাত্র ৩৫ শতাংশ।

তিনি বলেন, “আমাদের অধিকাংশ কর্মী কেবল শরীর নিয়ে বিদেশে যাচ্ছেন। তারা পেশাগত কোনো নির্দিষ্ট দক্ষতা ছাড়াই শ্রমবাজারে প্রবেশ করছেন, ফলে ঝুঁকির পাশাপাশি আয়ের পরিমাণও কম থাকে।”

এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার দেশজুড়ে ১১০টি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (টিটিসি) স্থাপন করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে কারিগরি শিক্ষা ও পেশাগত প্রশিক্ষণ নেওয়া গেলে দক্ষতা বাড়বে এবং বিদেশে ভালো চাকরি ও বেতনের সুযোগ পাওয়া যাবে।

অভিবাসন প্রতারণা রোধে সচেতনতা জরুরি

সেমিনারে আলোচকরা আরও বলেন, অনেক মানুষ মা-বাবা বা স্ত্রীর গয়না, জমিজমা বিক্রি করে বিদেশে পাড়ি জমান। কিন্তু সঠিক তথ্য ও কাগজপত্র না থাকায় অনেকে প্রতারণার শিকার হন।

তারা বলেন, “ভিসার পাশাপাশি রিক্রুটিং এজেন্সির কাছ থেকে অবশ্যই ‘অ্যাগ্রিমেন্ট পেপার’ এবং ‘ক্লিয়ারেন্স কার্ড’ নিতে হবে। এ দু’টি কাগজ থাকলে প্রতারণা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।”

সরকারি বিধান অনুযায়ী, অনুমোদিত ক্লিয়ারেন্স কার্ড নিয়ে বিদেশে গিয়ে যদি কেউ দুর্ঘটনার শিকার হন বা কোনো কারণে দেশে ফিরে আসেন, তবে সরকার থেকে দেড় লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়। আর কোনো প্রবাসীর মৃত্যু হলে তার পরিবার পায় তিন লাখ টাকা। তবে এই সুবিধা পেতে হলে বিদেশযাত্রার আগে নির্ধারিত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করাই শর্ত।

হুন্ডির পরিবর্তে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানোর পরামর্শ

সেমিনারে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোকে একটি মারাত্মক ভুল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং প্রবাসীর পরিবারও আইনি ঝুঁকিতে পড়ে।

বক্তারা বলেন, “ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করলে একদিকে দেশের অর্থনীতির ভিত্তি শক্ত হবে, অন্যদিকে প্রবাসীর উপার্জনের হিসাব সরকারের কাছে থাকবে। ভবিষ্যতে সরকারি সুযোগ-সুবিধাও পাওয়া সহজ হবে।”

দক্ষতা উন্নয়নই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি

টিটিসি রাজশাহীর অধ্যক্ষ নাজমুল হক বলেন, “শুধু বিদেশ যাওয়াই অভিবাসনের লক্ষ্য নয়, বরং কীভাবে একজন প্রবাসী বিদেশে নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করবেন সেটাই মূল বিষয়। এই লক্ষ্য পূরণে প্রযুক্তিগত ও ভাষাগত দক্ষতা অপরিহার্য।”

তিনি আরও বলেন, “সরকার প্রতিবছর বাজেটে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে নানা প্রণোদনা রাখে। কিন্তু দক্ষতা বাড়ানো ছাড়া প্রবাসে সাফল্য সম্ভব নয়।”

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

সেমিনারে উপস্থিত কর্মকর্তা ও অতিথিরা অভিবাসন ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ ও নিরাপদ করতে প্রশাসনিক উদ্যোগ জোরদারের তাগিদ দেন।

রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা) যোবায়ের হোসেন বলেন, “প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স শুধু পরিবারের খরচই মেটায় না, বরং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বড় চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। তাই প্রবাসী কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নের পাশাপাশি অভিবাসন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতেই হবে।”

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button