বিশ্ব

সিরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে রিয়াদে ট্রাম্পের ঐতিহাসিক বৈঠক

সিরিয়ার ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল–শারার সঙ্গে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে বৈঠক করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বুধবার অনুষ্ঠিত এই বৈঠক শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বিশ্ব কূটনীতির জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ মোড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই সাক্ষাৎ উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দিয়েছে, তারা সিরিয়ার ওপর থেকে সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে যাচ্ছে এবং দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়টি বিবেচনা করছে।

রিয়াদে বহুপাক্ষিক সম্মেলনে নাটকীয় ঘোষণা

রিয়াদে যুক্তরাষ্ট্র ও উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (GCC) দেশগুলোর সম্মেলনের সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সিরিয়ার নতুন নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে সৌদি রাষ্ট্রীয় টিভিতে ট্রাম্প ও শারার করমর্দনের ছবি সম্প্রচারিত হয়, যা বৈঠকটির তাৎপর্য আরও জোরালো করে তোলে।

যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানে বড় নীতিগত পরিবর্তন

এই বৈঠকের ঠিক আগে হোয়াইট হাউস জানায়, সিরিয়ার ইসলামপন্থী সরকারকে কেন্দ্র করে আরোপিত দীর্ঘমেয়াদি নিষেধাজ্ঞাগুলো প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওয়াশিংটন। বিষয়টি মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। ২০১১ সালে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের পর সিরিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের কড়া নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল।

ট্রাম্পের আহ্বান: ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করুন

বৈঠকে ট্রাম্প সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট শারার কাছে একটি স্পষ্ট আহ্বান জানান—ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করতে সিরিয়ার অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেই উদ্দেশ্যে শারাকে আহ্বান জানিয়েছেন।”

শারার বিতর্কিত অতীত নিয়ে উদ্বেগ

যদিও ট্রাম্প প্রশাসনের কিছু অংশ আহমেদ আল–শারার অতীত নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ, তিনি এক সময় আল-কায়েদার সিরিয়া শাখা ‘জভাত আল-নুসরা’-এর নেতা ছিলেন। ইরাকে অবস্থানকালে তিনি এই জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেন এবং পাঁচ বছর মার্কিন সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী ছিলেন।

২০১৬ সালে তিনি সংগঠন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন এবং ২০২৪ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধে বড় ধরনের জয় পেয়ে প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। এরপর গত ডিসেম্বরে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে সিরিয়ার নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর শাসন শুরুর পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বে তার নেতৃত্ব নিয়ে মতভেদ ছিল।

ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া সংরক্ষিত

ট্রাম্পের ঘোষণার পর ইসরায়েল এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে দেশটির নিরাপত্তা কর্মকর্তারা আগেও শারাকে একজন ‘জিহাদি নেতা’ বলে উল্লেখ করে আসছিলেন। এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে অনেকেই চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করছেন।

সৌদি আরব ও তুরস্কের সমর্থন

এ সম্মেলনে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। এছাড়া তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান সম্মেলনে ভার্চ্যুয়ালি অংশ নেন এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও অর্থনৈতিক সংযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান।

পুরস্কার প্রত্যাহার ও আন্তর্জাতিক গ্রহনযোগ্যতা

মার্কিন কর্তৃপক্ষ গত ডিসেম্বরে শারার মাথার দাম হিসেবে ঘোষিত ১০ মিলিয়ন ডলারের পুরস্কার প্রত্যাহার করে নেয়, যা ছিল তাঁর বৈধতা পাওয়ার পথে একটি বড় পদক্ষেপ। এরপর মার্চ মাসে বাশারপন্থীদের সঙ্গে ইসলামপন্থীদের সংঘর্ষে শত শত লোক নিহত হলেও, শারার নেতৃত্বে সিরিয়ায় বর্তমানে একটি কার্যকর শাসন কাঠামো গড়ে উঠছে বলে যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে।

সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের সম্ভাব্য প্রভাব

বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র-সিরিয়া সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে:

  • সিরিয়ায় পুনর্গঠন ও মানবিক সহায়তা ত্বরান্বিত হবে,
  • ইরান-সিরিয়া ঘনিষ্ঠতা হ্রাস পাবে,
  • যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে কৌশলগত ভারসাম্য ফিরবে।

এছাড়া শারার সরকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলে পশ্চিমা বিনিয়োগকারীরাও সিরিয়ার পুনর্গঠন কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে উৎসাহিত হতে পারেন।

সমাপ্তি: অজানা আশঙ্কা ও কূটনৈতিক জটিলতা

তবে এই উদ্যোগ কতটা টেকসই হবে, তা নিয়ে এখনো প্রশ্ন রয়ে গেছে। কারণ, শারার অতীত, ইসরায়েলের সন্দেহ ও অভ্যন্তরীণ সহিংসতা সিরিয়াকে একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

তবুও রিয়াদে এই ঐতিহাসিক বৈঠক মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান কূটনৈতিক সমীকরণে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এখন দেখার বিষয়, যুক্তরাষ্ট্র ও সিরিয়ার মধ্যকার সম্পর্ক কোন দিকে গড়ায়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button