গাজায় এক রাতেই ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৫১, ভয়াবহতা বেড়েই চলেছে

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর টানা আক্রমণে এক রাতেই প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৫১ জন ফিলিস্তিনি। মঙ্গলবার দিবাগত রাতভর উত্তর গাজার জাবালিয়া, শাজাইয়া এবং খান ইউনুসে চালানো বিমান ও স্থল অভিযানে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। চিকিৎসাকর্মী ও স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোর বরাতে আল-জাজিরা জানিয়েছে, নিহতদের অধিকাংশই জাবালিয়ার বাসিন্দা।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গত কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালগুলোয় একের পর এক লাশ আসতে থাকে। হাসপাতালের করিডোরে জায়গা না থাকায় অনেক লাশ মেঝেতে রেখেই চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যেতে হচ্ছে। হাসপাতালের সামনে স্বজনদের আহাজারিতে আকাশ ভারী হয়ে উঠেছে।
গাজা শহরের দক্ষিণাঞ্চলের খান ইউনুসেও ইসরায়েলি বাহিনী নতুন করে হামলা শুরু করেছে। সেখানে অন্তত পাঁচটি ভবনে বিমান হামলা চালানো হয়, যার ফলে পুরো পরিবার ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে বলে জানা গেছে। উদ্ধারকাজে নিয়োজিত কর্মীরা জানিয়েছেন, ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও অনেক মানুষের আটকে থাকার আশঙ্কা রয়েছে।
যুদ্ধ বন্ধে তৎপর যুক্তরাষ্ট্র, দৃঢ় অবস্থানে ইসরায়েল
এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে সৌদি আরব সফরে রয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি জানিয়েছেন, গাজায় সহিংসতা বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও তাঁর বক্তব্যে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথা জানা যায়নি।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আগের মতোই কঠোর অবস্থানে রয়েছেন। তিনি বলেন, “যুদ্ধ আমরা চালিয়ে যাব, যতক্ষণ না আমাদের লক্ষ্য পূরণ হয়। হামাসের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত থামব না।”
নেতানিয়াহুর এমন ঘোষণার পরই ধারণা করা হচ্ছে, গাজার ওপর হামলা আরও ভয়াবহ হতে পারে। এই অবস্থায় সাধারণ ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।
৭ অক্টোবরের পর থেকে গণহত্যার অভিযোগ
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে আকস্মিক হামলা চালিয়ে ১,১৩৯ জনকে হত্যা করে এবং দুই শতাধিক মানুষকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায়। এই হামলার জবাবে ইসরায়েলও গাজায় ব্যাপক হামলা শুরু করে। প্রথম দিকে প্রতিক্রিয়াশীল হামলা হলেও সময়ের সাথে সাথে তা রূপ নেয় টানা এবং ব্যাপক সামরিক অভিযানে।
গাজা উপত্যকায় গত প্রায় ১৯ মাসে ইসরায়েলি হামলায় ফিলিস্তিনিদের মৃত্যু সংখ্যা এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসাব বলছে, এখন পর্যন্ত সেখানে ৫২ হাজার ৯০৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ১ লাখ ১৯ হাজার। অন্যদিকে, গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের মতে, প্রকৃত নিহতের সংখ্যা ৬১ হাজার ৭০০ ছাড়িয়ে গেছে। কারণ হাজার হাজার মানুষ এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে নিখোঁজ। তাঁদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
মানবিক বিপর্যয় এবং আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
গাজা পরিস্থিতিকে “মানবিক বিপর্যয়” হিসেবে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘ। তাদের তথ্যমতে, উপত্যকার প্রায় ২২ লাখ মানুষের মধ্যে ৮০ শতাংশই এখন বাস্তুচ্যুত। খাদ্য, পানি, ওষুধ ও বিদ্যুৎ সংকটে ধুঁকছে গাজা। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থা হুঁশিয়ারি দিয়েছে, অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডে গণহত্যার আশঙ্কা প্রবল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানিয়েছে, গাজায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ধস নেমেছে। বেশিরভাগ হাসপাতাল বা ধ্বংসস্তূপে পরিণত, অথবা চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।
অপরদিকে, ইসরায়েল তাদের অবস্থান থেকে এক চুলও সরছে না। তারা বলছে, হামাসকে নিশ্চিহ্ন করতেই এই অভিযান। তবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, ইসরায়েলের এই ‘সামরিক প্রতিশোধ’ মাত্রাতিরিক্ত এবং তা সরাসরি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে।
আরেকটি প্রজন্ম হারানোর পথে
গাজায় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সবই বন্ধ। শিক্ষার সুযোগ হারাচ্ছে শিশুরা। ইউনিসেফ-এর মতে, চলমান যুদ্ধ ফিলিস্তিনিদের আরেকটি প্রজন্মকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, যদি যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয়, তবে শুধু মানবিক বিপর্যয় নয়, এটি একটি পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়তে পারে লেবানন, সিরিয়া এমনকি জর্ডান ও মিসর পর্যন্ত।
সমাধান কোথায়?
এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মহলের অনেকেই দুই রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানের কথা বলছেন। ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। তবে রাজনৈতিকভাবে এই সমাধান বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ এখনও দৃশ্যমান নয়।
যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে, ততই ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্ভোগ বাড়ছে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ কঠিন হয়ে পড়ছে।
সংক্ষেপে:
- গাজায় এক রাতেই নিহত ৫১
- শুরু থেকে এখন পর্যন্ত নিহত ৬০ হাজারের বেশি
- আহত ১ লাখ ১৯ হাজারেরও বেশি
- স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ধসে পড়েছে
- নেতানিয়াহুর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা
- আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ বাড়ছে