আশার আলো ছড়াল বৈঠক, কিন্তু বাজারে ফের মলিনতা

গত রোববার পুঁজিবাজারের অবনতি ঠেকাতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস আহ্বান করেন উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক। দীর্ঘ নয় মাস ধরে দরপতনের ধারাবাহিকতায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা স্তরহীন, তাই এই বৈঠকের দিকে তাকিয়েছিল সারা দেশে শেয়ার ট্রেডার, বিনিয়োগ বিশ্লেষক এবং বাজার অংশীজন। কিন্তু বৈঠকের পাঁচ দফা নির্দেশনা প্রকাশের পরেও দেখা গেল, বাজার আবারই নেমে এলো নিম্নগামী স্রোতে। ডিএসই ও সিএসই উভয় প্রতিষ্ঠানে বইল হতাশার ছায়া।
বৈঠকের পাঁচ দফা প্রস্তাব ও তাঁদের সীমাবদ্ধতা
ড. ইউনূসের সভায় উত্থাপিত পাঁচ মূল নির্দেশনা ছিল:
- সরকারি সংস্থাগুলোর তালিকাভুক্তি: দেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান বিক্রয় বা সর্বসাধারণের জন্য শেয়ার বাজারে আনা।
- প্রতিষ্ঠিত বড় কোম্পানির তালিকাভুক্তি: দেশি- বিদেশি বৃহৎ কর্পোরেটগুলোর শেয়ার তালিকাভুক্তি প্রসারিত করার আহ্বান।
- দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের আইনি ব্যবস্থা: পুঁজিবাজারে অনিয়ম ও দুর্নীতির দায়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ।
- বন্ড ইস্যুয়ের মাধ্যমে পুঁজির যোগান: ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে বিনিয়োগ আকর্ষণ।
- ফরেন এক্সপার্ট আহ্বান: তিন মাসের মধ্যে পরামর্শক হিসাবে বিদেশি বিশেষজ্ঞ এনে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার সম্পন্ন করার উদ্যোগ।
তবে বাজার বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রস্তাবনাগুলো মূল সমস্যার মুলদৈর্ঘ্য থেকে অনেক দূরে। দীর্ঘমেয়াদী সংস্কার পরিকল্পনা এবং অংশীজনের প্রবৃদ্ধি নির্বিঘ্ন করার পরিকল্পিত কৌশল প্রদানের পরিবর্তে পেশকৃত দিকনির্দেশনাগুলো ছিল আংশিক এবং অপর্যাপ্ত।
বিনিয়োগকারীর চোখে হতাশা
সাবেক সভাপতি বিনিয়োগ বিশ্লেষক চান্দ্র বিক্রান্ত বলেন, “সরকারি সংস্থার শেয়ার তালিকাভুক্তি নতুন নয়, এ ধরনের চেষ্টা আগেও হয়েছে। কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।” অন্য একটি ব্রোকারেজ হাউজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক যোগ করেন, “দীর্ঘ বছর ধরে পুঁজিবাজারে যারা কাজ করছেন, তাদের মতামত ছাড়া যে সংস্কার প্রস্তাব, তা কার্যকর হওয়া প্রায় অসম্ভব।”
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি মার্চেন্ট ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “ফরেন এক্সপার্ট আনার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু তাদের অধীনে কাজ চালানোর কোন রূপরেখা বা বাজেট আলোচনা হয়নি। ঘুমন্ত প্রধান নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে (বিএসইসি) অতিরিক্ত নির্দেশনা দিয়ে সমাধান আসবে না।”
তাজা পরিসংখ্যান: সূচকের পতন ও লেনদেনের পরিমাণ
গত ১৩ মে, মঙ্গলবার, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ৪৬.৯৭ পয়েন্ট বা ০.৯৫%, যা বাজারের মন্দা কাটতে না পেরে বিনিয়োগকারীদের হতাশা আরও বাড়িয়েছে। লেনদেনের টোটাল ভ্যালু সাড়ে তিনশ কোটি টাকা ছাড় করেনি।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) সামগ্রিক সূচকের পতন প্রায় ৩৭ পয়েন্ট, আর লেনদেনের পরিমাণ মাত্র সাত কোটি টাকা। পরিসংখ্যান চালিয়ে নিয়ে আসছে যে, বৈঠক বা ঘোষণার জোরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
সমস্যার গভীরে: কি বলছে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা?
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট নানা সূত্র বলছে:
- বেসরকারি বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা: দীর্ঘমেয়াদী বাজেট পরিকল্পনা ছাড়া বিদেশি এবং ঘরের বিনিয়োগকারীরা ভ্যাকুয়াম অনুভব করছেন।
- বিএসইসির একপেশে সিদ্ধান্তগ্রহণ: এক্ষেত্রে অংশীজন, বিনিয়োগকারী, ব্রোকার ও মিডিয়ার সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা হয়নি।
- অভ্যন্তরীণ স্বচ্ছতার অভাব: কোন প্রক্রিয়ায় শেয়ার তালিকাভুক্তি বা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের শাস্তি কার্যকর হবে, এ বিষয়ে নির্দেশনা স্পষ্ট নয়।
ব্রোকারেজ হাউজ সিইও অনিরুদ্ধ করিম বলেন, “টেকসই সংস্কার তখনই সম্ভব, যখন অংশীজনদের মতামত নিয়ে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গড়া হয়। বাইরের পরামর্শক আনার আগে ঘরের মেধা কাজে লাগাতে হবে।”
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট: অন্যান্য উদাহরণ থেকে শেখার সুযোগ
পশ্চিম এশিয়ার উন্নয়নশীল স্টক মার্কেটগুলো দেখুন—সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবি এক্সচেঞ্জ সম্প্রতি দেশি-বিদেশি যৌথ উদ্যোগে বিনিয়োগ আকর্ষণ করে সূচক উন্নীত করেছে। সেখানে মূলমন্ত্র ছিল অংশীদারিত্ব ভিত্তিক গণমুখী সংস্কার। আর মালয়েশিয়ার পিছিয়ে পড়া পুঁজিবাজার উন্নয়নে সুশাসন ও স্বচ্ছতা ফিরিয়ে এনে সফল হয়েছে। এই সব উদাহরণ থেকে সামনে শেখার বহু কিছু রয়েছে।
পরবর্তী করণীয়: কী করা উচিত?
বিশ্লেষকদের পরামর্শ:
- উদ্দেশ্য নির্ধারণ: দীর্ঘমেয়াদী সংস্কার পদ্ধতি আবশ্যক, শুধু তিন মাস নয়।
- অংশীজন নিয়ে কাজ: বিনিয়োগকারী, ব্রোকার, কোম্পানি প্রতিনিধি, মিডিয়া—সবকেউ অংশ নিক সার্বিক পরিকল্পনায়।
- স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি: প্রতিটি নির্দেশনার বাস্তবায়ন টার্গেট নির্ধারণ ও সিটি বাসে পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা।
- বন্ড ইস্যু বাস্তবায়ন: ব্যাংক ঋণের বিকল্প খাতে বন্ড ইস্যু ত্বরান্বিত করতে ইন্ডাস্ট্রি বোর্ড গঠন।
- দীর্ঘমেয়াদী বিদেশি অংশীদার: কেবল পরামর্শ নয়, প্রতিশ্রুতিপত্র ও বিনিয়োগ চুক্তির মাধ্যমে বিদেশি অংশীজনকে আনা।
বিনিয়োগকারীর মনোবল পুনর্গঠন ও বাজারের ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শেয়ারবাজারের শক্তির ওপর নির্ভর করে। সেজন্যই এ মুহূর্তে ক্রমাগত পতন নয়, বরং স্থিতিশীলতার জন্য দৃঢ় কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি। বিনিয়োগকারীরা প্রত্যাশা করেন কার্যকর সংস্কার নিয়ে ব্যস্ত একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা, যাদের প্রতি আস্থা থাকবে। তাদের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা হলেই পুঁজিবাজার ধীরে ধীরে পুনরুজ্জীবিত হবে।
অর্থনীতি আবার উত্সবমোদী ছন্দে ফিরতে পারে, যদি সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা অংশীদারদের সাথে মিথস্ক্রিয়া বাড়ায় এবং বাজার সমৃদ্ধিতে সেরা কার্যকর কৌশল চτήσει। তখনই শেয়ারবিনিয়োগ শুধুমাত্র লাভের সোপান হবে না, দেশের অর্থনীতির অবকাঠামো গড়ে তুলবে শক্ত ভিত্তি।