অর্থনীতি

সেবাখাত ও আমদানি নির্ভর পণ্যে চাপ, মূল্যস্ফীতিতে দীর্ঘমেয়াদি উদ্বেগ

দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি এখনো ৯ শতাংশের ওপরে রয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা কমলেও এটি এখনো কাঙ্ক্ষিত স্তরে নেমে আসেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ মূল্যস্ফীতি পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, খাদ্যপণ্যের দামের কিছুটা স্থিতিশীলতা থাকলেও খাদ্যবহির্ভূত সেবা ও আমদানিনির্ভর ভোগ্যপণ্যের ব্যয় বৃদ্ধির কারণে সার্বিক মূল্যস্ফীতি তেমন কমেনি। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই পরিস্থিতি দীর্ঘ মেয়াদে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

খাদ্যপণ্যে স্বস্তি, তবে জ্বালানি ও ইলেকট্রনিক পণ্যে চাপে ভোক্তা

২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ—এই তৃতীয় প্রান্তিকের তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে শাকসবজি, মাছ, ডিম, মাংসের মতো পচনশীল পণ্যের দামে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। তবে অপচনশীল পণ্য যেমন তেল, ডাল, চিনি, আটার দাম কিছুটা কমে এসেছে। এতে সাময়িকভাবে খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে স্বস্তি এসেছে।

অন্যদিকে, আমদানিনির্ভর খাদ্যবহির্ভূত পণ্য যেমন গ্যাস, ডিজেলসহ জ্বালানি পণ্য, মোবাইল, ল্যাপটপের মতো ইলেকট্রনিক্স পণ্য ও অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। একই সঙ্গে বাসাভাড়া, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা—এইসব সেবাখাতে ব্যয়ও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। এই দুই খাত—সেবা ও আমদানিনির্ভর ভোগ্যপণ্য—বর্তমানে মূল্যস্ফীতির মূল চালক হয়ে উঠেছে।

সেবাখাতের ব্যয় বাড়লে কমে না সহজে

অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, সেবাখাতের ব্যয় একবার বেড়ে গেলে তা সহজে কমে না। বিশেষ করে বাসাভাড়া, স্কুলের বেতন, হাসপাতাল খরচ ইত্যাদি খাতে মূল্য হ্রাস প্রায় অসম্ভব। তাই এই খাতে ব্যয়বৃদ্ধি হলে তা জনগণের জীবনযাত্রায় স্থায়ী চাপ তৈরি করে। বাংলাদেশ ব্যাংকও তাদের প্রতিবেদনে এই বিষয়টি তুলে ধরেছে।

মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে কেন?

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ প্রান্তিকে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৯.৫ শতাংশে। এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে শীতকালীন শাকসবজির সরবরাহ বৃদ্ধি, রমজানের আগে খাদ্যপণ্যে আমদানি শুল্ক কমানো এবং কিছু পণ্যে বিশ্ববাজারে দাম কমে আসা। বিশেষ করে পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, মসলার দামে রমজানের আগমুহূর্তে স্বস্তি দেখা দেয়।

প্রোটিনজাত পণ্যে চাপ

তবে খাদ্যপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতির প্রভাব দেখা গেছে মাছ, মাংস ও ডিমের মতো প্রোটিনজাত পণ্যে। চাল, আটা ও শাকসবজির দামে তুলনামূলক স্থিতিশীলতা থাকলেও প্রোটিনের দাম বাড়তি থাকায় সামগ্রিক খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে তা প্রভাব ফেলেছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভোক্তাদের খাদ্যগ্রহণের পরিমাণে এই চাপের প্রভাব পড়ছে। স্বল্প আয়ের মানুষ প্রোটিনের ঘাটতির মুখে পড়ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে পুষ্টি সংকটের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

জ্বালানির অবদান কমেছে, তবুও চাপ

২০২২ সালে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতিতে জ্বালানির অবদান ছিল সর্বোচ্চ। তবে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে তা কমতে শুরু করে। চলতি বছরের মার্চে জ্বালানির অবদান কমে মাত্র ১ শতাংশে নেমে এসেছে, যেখানে গত বছরের একই সময়ে এটি ছিল ২৬ শতাংশ। অর্থাৎ জ্বালানির দাম নিয়ন্ত্রণে এলেও অন্যান্য খাতে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতির সামগ্রিক চিত্রে স্বস্তি আসছে না।

আন্তর্জাতিক সংস্থার মূল্যস্ফীতি পূর্বাভাস

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এডিবি ও আইএমএফের মূল্যস্ফীতি পূর্বাভাসও তুলে ধরা হয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি থাকতে পারে। তবে বছরের শেষ দিকে এটি কিছুটা কমবে বলে আশাবাদ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।

অন্যদিকে আইএমএফ এর এপ্রিল মাসের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে জানিয়েছে, এ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশে পৌঁছাতে পারে, তবে পরবর্তী অর্থবছরে এটি ৫ শতাংশে নেমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। আইএমএফ এ ক্ষেত্রে অনুকূল আবহাওয়া, বৈশ্বিক বাজারে পণ্যমূল্য হ্রাস এবং কঠোর আর্থিক নীতির উল্লেখ করেছে।

মজুরি বাড়ছে না, বাড়ছে ব্যয়

মূল্যস্ফীতির চাপের বিপরীতে দেশের শ্রমজীবী মানুষের মজুরি কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়েনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে শুরু করে প্রতিনিয়ত মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির তুলনায় কম। ফলে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের খরচ সামাল দেওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে।

ভবিষ্যৎ ঝুঁকি

বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যায়নে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি কিছুটা কমেছে ঠিকই, কিন্তু এর পেছনে রয়েছে অস্থায়ী কারণ। খাদ্যবহির্ভূত খাতে যে চাপ তৈরি হয়েছে তা দীর্ঘমেয়াদে ভোক্তাদের ওপর ভারী হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসাভাড়া, যোগাযোগ ইত্যাদি খাতে ব্যয় নিয়ন্ত্রণে না এলে ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতির হার আবার বাড়তে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button