বানিজ্য

বিশ্বের শীর্ষ পরিবেশবান্ধব কারখানা এখন গাজীপুরের তাসনিয়া ফেব্রিকস

গাজীপুরের তাসনিয়া ফেব্রিকস লিমিটেড যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) প্রদত্ত লিড (লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন) সনদে সর্বোচ্চ নম্বর অর্জন করে বিশ্বের শীর্ষ পরিবেশবান্ধব কারখানার স্বীকৃতি লাভ করেছে। কারখানাটির প্রশাসনিক ভবন ১১০ নম্বরের মধ্যে ১০৭ নম্বর পেয়ে এই মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান অর্জন করেছে। একই সঙ্গে তাসনিয়া ফেব্রিকসের পোশাক কারখানা ভবনও ১০৬ নম্বর পেয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ পরিবেশবান্ধব কারখানার তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এই অর্জন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের জন্য একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক।

তাসনিয়া ফেব্রিকসের অভাবনীয় সাফল্য

৮ মে ২০২৫ তারিখে ইউএসজিবিসি তাসনিয়া ফেব্রিকসের প্রশাসনিক ভবন এবং পোশাক কারখানা ভবনকে পরিবেশবান্ধব সনদ প্রদান করে। প্রশাসনিক ভবনের ১০৭ নম্বর এবং পোশাক কারখানা ভবনের ১০৬ নম্বর বিশ্বের অন্যান্য কারখানার তুলনায় অভূতপূর্ব। এর আগে গাজীপুরের এসএম সোর্সিং ১০৬ নম্বর পেয়ে বিশ্বের শীর্ষ পরিবেশবান্ধব কারখানার স্বীকৃতি ধরে রেখেছিল। তাসনিয়া ফেব্রিকসের প্রশাসনিক ভবন এখন সেই অবস্থান দখল করেছে, এবং তাদের পোশাক কারখানা ভবন এসএম সোর্সিংয়ের সঙ্গে যৌথভাবে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) মঙ্গলবার (১৩ মে ২০২৫) জানিয়েছে, তাসনিয়া ফেব্রিকসের এই অর্জনের পাশাপাশি মির্জাপুরের কমফিট গোল্ডেন লিফ নামে আরেকটি কারখানাও লিড সনদ পেয়েছে। এই কারখানাটি ৮০ নম্বর পেয়ে লিড প্লাটিনাম সনদ লাভ করেছে। এই তিনটি স্থাপনার সনদ প্রাপ্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা এখন ২৪৩টিতে দাঁড়িয়েছে।

লিড সনদ: পরিবেশবান্ধব স্থাপনার সর্বোচ্চ মান

ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠান, যারা বিশ্বব্যাপী পরিবেশবান্ধব স্থাপনার জন্য ‘লিড’ সনদ প্রদান করে। লিড সনদ পাওয়ার জন্য একটি প্রকল্পকে নির্মাণ থেকে উৎপাদন পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে কঠোর মানদণ্ড মেনে চলতে হয়। এই সনদের জন্য ৯টি শর্ত পরিপালন করতে হয়, যার মোট নম্বর ১১০। নম্বরের ভিত্তিতে সনদ চারটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত:

  • লিড প্লাটিনাম: ৮০ নম্বরের বেশি
  • লিড গোল্ড: ৬০-৭৯ নম্বর
  • লিড সিলভার: ৫০-৫৯ নম্বর
  • লিড সার্টিফায়েড: ৪০-৪৯ নম্বর

তাসনিয়া ফেব্রিকসের প্রশাসনিক ভবন এবং পোশাক কারখানা ভবন উভয়ই লিড প্লাটিনাম সনদ পেয়েছে, যা তাদের পরিবেশবান্ধব স্থাপনার শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ।

বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব কারখানার আধিপত্য

বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতে লিড সনদপ্রাপ্ত পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা ২৪৩টি। এর মধ্যে ১০১টি লিড প্লাটিনাম, ১২৮টি গোল্ড, ১০টি সিলভার এবং ৪টি সার্টিফায়েড সনদ পেয়েছে। বিশ্বের শীর্ষ ১০টি পরিবেশবান্ধব কারখানার মধ্যে ৯টিই বাংলাদেশের। এই তালিকায় রয়েছে তাসনিয়া ফেব্রিকসের প্রশাসনিক ভবন, এসএম সোর্সিং, তাসনিয়া ফেব্রিকসের পোশাক কারখানা, গ্রিন টেক্সটাইল, নিট এশিয়া, ইন্টিগ্রা ড্রেসেস, রেমি হোল্ডিংস, ফতুল্লা অ্যাপারেলস এবং একটি গোপন পরিচয়ের প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশের এই অর্জন বিশ্বব্যাপী তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে অগ্রগামী অবস্থানের প্রতিফলন। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর দেশি-বিদেশি সমালোচনার মুখে পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব কারখানা নির্মাণে মনোযোগী হন। এর ফলে বাংলাদেশ এখন পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা ও মানের দিক থেকে বিশ্বে শীর্ষে।

তাসনিয়া ফেব্রিকসের অর্জনের তাৎপর্য

তাসনিয়া ফেব্রিকসের এই সাফল্য শুধু প্রতিষ্ঠানের জন্যই নয়, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্যও গর্বের বিষয়। পরিবেশবান্ধব কারখানাগুলো বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবহারে দক্ষতা বাড়ায়, কার্বন নিঃসরণ কমায় এবং শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করে। এই কারখানাগুলোতে উৎপাদিত পণ্যের গায়ে ‘গ্রিন ট্যাগ’ সংযুক্ত থাকে, যা বিশ্ববাজারে ক্রেতাদের কাছে আলাদা মূল্যবান।

বিজিএমইএর একজন পরিচালক জানান, “পরিবেশবান্ধব কারখানাগুলো আমাদের ব্র্যান্ড ইমেজ বাড়াচ্ছে। এটি বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে দর কষাকষিতে সুবিধা এনে দেয় এবং বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের প্রতি আস্থা বাড়ায়।” তাসনিয়া ফেব্রিকসের এই অর্জন বৈশ্বিক ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে।

পরিবেশবান্ধব কারখানার উত্থান: বাংলাদেশের যাত্রা

বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব কারখানার যাত্রা শুরু হয় ২০১২ সালে, যখন পাবনার ঈশ্বরদী ইপিজেডে ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও প্রথম লিড সনদ পায়। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে এই সংখ্যা বাড়ছে। ২০২২ সালে ৩০টি, ২০২৩ সালে ২৪টি এবং ২০২৪ সালে ২৪টি কারখানা লিড সনদ পেয়েছে। ২০২৫ সালে এখন পর্যন্ত তাসনিয়া ফেব্রিকস এবং কমফিট গোল্ডেন লিফের তিনটি স্থাপনা সনদ পেয়েছে।

বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি লিড সনদপ্রাপ্ত কারখানার মধ্যে ৬২টি বাংলাদেশের। এই সংখ্যা বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ, চীনে ১০টি, পাকিস্তানে ৯টি এবং ভারত ও শ্রীলঙ্কায় ৬টি করে লিড সনদপ্রাপ্ত কারখানা রয়েছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বিজিএমইএ জানিয়েছে, বর্তমানে পাইপলাইনে আরও পাঁচ শতাধিক পরিবেশবান্ধব কারখানা নির্মাণাধীন রয়েছে। এই কারখানাগুলো সনদ পেলে বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা আরও বাড়বে। এছাড়া, পরিবেশবান্ধব কারখানার ব্র্যান্ডিং বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সহায়তা করবে।

তাসনিয়া ফেব্রিকসের এই অর্জন বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এটি বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের সুনাম বাড়াবে এবং পোশাক রপ্তানিতে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে।

উপসংহার

তাসনিয়া ফেব্রিকসের এই অভাবনীয় অর্জন বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্য একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। বিশ্বের শীর্ষ পরিবেশবান্ধব কারখানার তালিকায় বাংলাদেশের আধিপত্য প্রমাণ করে যে, দেশটি শুধু উৎপাদন ক্ষমতায় নয়, টেকসই উন্নয়নেও বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। তাসনিয়া ফেব্রিকসের এই সাফল্য বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাদের জন্য একটি উৎসাহব্যঞ্জক দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button