অর্থনীতি

এনবিআর বিলুপ্তি নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই: আশ্বস্ত করলেন অর্থ উপদেষ্টা

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে রাজস্ব প্রশাসন পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে যে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে, তা অপ্রয়োজনীয় বলে মন্তব্য করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি আশ্বস্ত করে বলেন, এই পরিবর্তনে রাজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থল বা দায়িত্বে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। বরং বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশেও রাজস্ব নীতি ও বাস্তবায়নকে আলাদা বিভাগে ভাগ করাই বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ।

রাজস্ব প্রশাসনের পুনর্গঠন ও প্রেক্ষাপট

গতকাল (১২ মে) রাতে সরকার এক অধ্যাদেশ জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR)অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (IRD) বিলুপ্ত ঘোষণা করে। পরিবর্তে গঠিত হয় ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’। এই দুই নতুন বিভাগ নীতিগত পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের দায়িত্ব ভাগ করে পালন করবে।

তবে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা এনবিআর কাঠামোর এমন ভাঙনের খবর সামনে আসতেই, আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে অনিশ্চয়তা ও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষিতে আজ মঙ্গলবার অর্থ উপদেষ্টা এ বিষয়ে অবস্থান ব্যাখ্যা করেন।

কর্মকর্তাদের আশ্বস্ত করলেন অর্থ উপদেষ্টা

সচিবালয়ে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সালেহউদ্দিন বলেন,

“এনবিআর বিলুপ্ত হলেও কর্মকর্তাদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। যাঁরা সেখানে কর্মরত, তাঁদের কর্মসংস্থান বা দায়িত্বে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। বরং এই সংস্কারের ফলে তারা আরও স্পষ্ট কাঠামোর অধীনে কাজ করতে পারবেন।”

তিনি আরও বলেন,

“বিশ্বের অন্যান্য দেশেও কর নীতি এবং কর ব্যবস্থাপনা আলাদা বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। একটি বিভাগ নীতি প্রণয়ন করবে, অপরটি সেই নীতির বাস্তবায়ন দেখবে। যাঁরা নীতি তৈরি করবেন, তাঁদের জিডিপি, রাজস্ব প্রবণতা, অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকতে হবে। নীতিনির্ধারক আর কর সংগ্রাহক একই ব্যক্তি হলে স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, কার্যকারিতা কমে যায়।”

রাজস্ব আদায়ের বর্তমান অগ্রগতি

বর্তমান রাজস্ব পরিস্থিতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন,

“চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রাজস্ব আদায় গত বছরের তুলনায় ২ শতাংশ বেশি হয়েছে। এটা খুব হতাশাজনক নয়, বরং আমাদের প্রত্যাশা আরও বেশি। অন্তত গত বছরের তুলনায় রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হবে না।”

এর মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চান, এনবিআরের বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে নেওয়া হয়নি, বরং রাজস্ব প্রবৃদ্ধির ইতিবাচক প্রবণতার মাঝেই এটি বাস্তবায়িত হয়েছে।

বাজেট ঘাটতি নিয়ে বক্তব্য

আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট সম্পর্কে অর্থ উপদেষ্টা বলেন,

“বাজেটে বড় ঘাটতি থাকবে না। আমরা বাস্তবতার ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহণ করব এবং এডিপি বাস্তবায়ন করব। বাজেট বাস্তবায়নে টাকা ছাপানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি করব না, বরং প্রয়োজন হলে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো বৈদেশিক উৎস থেকে সহায়তা নেব।”

তিনি আরও বলেন, বাজেট ঘাটতি কিছুটা থাকলেও তা অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করবে না, কারণ সরকার আগেভাগেই তা মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এনবিআর বিলুপ্তির পেছনে বাস্তব কারণ

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ স্পষ্ট ভাষায় বলেন,

“যাঁরা নীতি প্রণয়ন করবেন, তাঁরা একইসঙ্গে কর সংগ্রহও করবেন, এটা বাস্তবসম্মত নয়। এতে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা দুটোই বিঘ্নিত হয়।”

এই দৃষ্টিকোণ থেকেই এনবিআরের একীভূত কাঠামো ভেঙে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ গঠন করা হয়েছে—একটি নীতিনির্ধারণে, অন্যটি বাস্তবায়নে।

তিনি এও জানান, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এনবিআরের শীর্ষ কর্মকর্তা এবং প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে।

কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ: প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি

এনবিআরের ভাঙন নিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে অনেক কর্মকর্তা ক্ষুব্ধ। তাদের অভিযোগ, সরকার বিসিএস (আয়কর) ও (কাস্টমস) ক্যাডার কর্মকর্তাদের মতামত উপেক্ষা করেই ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ’ জারি করেছে।

তবে অর্থ উপদেষ্টার মতে, এটি একটি প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কার যা শুধু বাংলাদেশের রাজস্ব প্রশাসনকেই নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেই আরও শক্তিশালী করবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্তির সিদ্ধান্তটি দীর্ঘদিন ধরে চলা প্রশাসনিক কাঠামোর একটি বড় পরিবর্তন। এতে অনেকে আপাতদৃষ্টিতে দুশ্চিন্তা বা অনিশ্চয়তা অনুভব করলেও সরকারের অভিমত ও অর্থ উপদেষ্টার ব্যাখ্যা ইঙ্গিত করে, এটি একটি পরিকল্পিত, স্বচ্ছ এবং ভবিষ্যৎমুখী পদক্ষেপ।
এই সংস্কারের মাধ্যমে রাজস্ব প্রশাসনে পেশাদারিত্ব, জবাবদিহিতা ও দক্ষতা নিশ্চিত হবে বলেই প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button