জাতীয়

এনবিআর ও আইআরডি বিলুপ্ত করে গঠিত হচ্ছে দুটি নতুন বিভাগ

বাংলাদেশের রাজস্ব প্রশাসনে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) বিলুপ্ত করে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে দুটি নতুন প্রশাসনিক বিভাগ—‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’। এ লক্ষ্যে ১২ মে রাতে একটি অধ্যাদেশ জারি করেছে সরকার।

নতুন গঠিত এই দুই বিভাগের আলাদা আলাদা দায়িত্ব ও কার্যপরিধি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে দেশের কর প্রশাসনকে আরও আধুনিক, দক্ষ ও প্রণোদনামূলক করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

রাজস্ব নীতি বিভাগ: কর ব্যবস্থার রূপকার

রাজস্ব নীতি বিভাগ হবে মূলত দেশের কর কাঠামো ও রাজস্ব আইনের নীতিগত পরিকল্পক ও প্রণেতা। এই বিভাগ কর সংক্রান্ত নতুন আইন প্রণয়ন, কর নীতির রূপদান, করহারের যৌক্তিকতা নিরূপণ, কর অব্যাহতির সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ এবং রাজস্ব প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে গবেষণা-ভিত্তিক নীতিমালা তৈরি করবে।

বিভাগের দায়িত্ব:

১. কর কাঠামো উন্নয়ন:
দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিবেচনায় রেখে বিস্তৃত করভিত্তি গঠন, যৌক্তিক করহার নির্ধারণ এবং সীমিত কর অব্যাহতির নীতি অনুসরণ করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই কর ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে।

  1. আইন প্রণয়ন ও সংশোধন:
    স্ট্যাম্প আইন, আয়কর, ভ্রমণ কর, দান কর, সম্পদ কর, কাস্টমস, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), আবগারি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, সারচার্জসহ অন্যান্য শুল্ক ও ফি সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন বা সংশোধনের কাজ করবে এই বিভাগ।
  2. আন্তর্জাতিক চুক্তি ও নীতিমালা:
    আন্তর্জাতিক দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি (DTA), কাস্টমস সংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদন ও বিশ্লেষণের দায়িত্বও এই বিভাগের আওতায় থাকবে।
  3. গবেষণা ও ডেটা বিশ্লেষণ:
    রাজস্ব সম্পর্কিত তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ, প্রাক্কলন ও রাজস্ব প্রবণতার পূর্বাভাস তৈরি করা হবে। এ কাজের মাধ্যমে রাজস্ব নীতিকে সময়োপযোগী ও বাস্তবমুখী করা হবে।
  4. নিয়মিত নির্দেশনা ও ব্যাখ্যা:
    রাজস্ব নীতিমালা সংশ্লিষ্ট প্রজ্ঞাপন, এসআরও ও বিধিনিষেধ জারি, সংশোধন ও ব্যাখ্যার দায়িত্ব পালন করবে এই বিভাগ।

জনবল ও পরামর্শক কমিটি:

এই বিভাগের জনবল গঠন করা হবে কর প্রশাসন, কাস্টমস, অর্থনীতি, গবেষণা, প্রশাসন, নিরীক্ষা, পরিসংখ্যান ও আইন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে।
সরকার উপযুক্ত যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মকর্তাকে এই বিভাগের সচিব হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবে।

এ ছাড়া একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করা হবে, যাতে থাকবেন অর্থনীতিবিদ, রাজস্ব ও আইন বিশেষজ্ঞ, হিসাব ও নিরীক্ষা বিশ্লেষক, ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধি, পেশাজীবী প্রতিনিধি ও ট্যারিফ কমিশনের সদস্যরা। এই কমিটি রাজস্ব নীতি বিভাগকে নীতিগত পরামর্শ প্রদান করবে।

রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ: কর আদায় ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত নতুন রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ মূলত কর আইন ও নীতির বাস্তবায়ন, কর আদায়, সেবা প্রদানের মানোন্নয়ন এবং গোয়েন্দা ও নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার কাজ করবে।

বিভাগের দায়িত্ব:

১. আইন প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন:
কাস্টমস, আয়কর, ভ্যাটসহ সংশ্লিষ্ট কর আইন ও বিধিমালা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে বিভাগটি।

  1. আন্তর্জাতিক চুক্তি বাস্তবায়ন:
    আন্তর্জাতিক দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি এবং কাস্টমস বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো বাস্তবভাবে প্রয়োগের দায়িত্ব পালন করবে।
  2. করসেবা ও করজাল সম্প্রসারণ:
    জনগণকে কর প্রদানে উদ্বুদ্ধ করতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো, কর সেবা বৃদ্ধি করা এবং করজালের আওতা বাড়ানো এ বিভাগের মূল লক্ষ্য।
  3. পরিচালন প্রক্রিয়া ও সমন্বয়:
    রাজস্ব ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট পদ্ধতি প্রণয়ন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবল গঠন এবং রাজস্ব নীতি বিভাগের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা হবে।
  4. নিরীক্ষা ও গোয়েন্দা:
    কর ফাঁকি ও দুর্নীতি রোধে নিরীক্ষা ও গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনাও এই বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের মধ্যে পড়বে।

বিদ্যমান জনবলের ভাগ-বণ্টন

অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, এনবিআরের বর্তমানে কর্মরত জনবল রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগে স্থানান্তরিত হবে। তবে প্রয়োজনে সেখান থেকে নির্বাচিত জনবল রাজস্ব নীতি বিভাগেও পদায়ন করা যেতে পারে।

এই সিদ্ধান্তের ফলে এনবিআরের প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠন হবে এবং আগের তুলনায় বিভাজিত দায়িত্ব ও কার্যক্রম আরো নির্দিষ্ট ও দক্ষভাবে পরিচালিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

কীভাবে উপকৃত হবে রাজস্ব প্রশাসন?

বিশ্লেষকদের মতে, এনবিআর দীর্ঘদিন ধরে একক কর্তৃত্বাধীন একটি সংস্থা হিসেবে রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনার উভয় দিক একসঙ্গে সামলাচ্ছিল। এতে নীতিগত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি ছিল। এই দুই পৃথক বিভাগ গঠনের মাধ্যমে—

  • নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা বাড়বে।
  • নতুন প্রযুক্তিনির্ভর কর ব্যবস্থার পথ প্রশস্ত হবে।
  • জনগণের কর সচেতনতা ও সেবার মান বাড়ানো যাবে।
  • করজালের আওতা ও রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে।

সরকারের এই যুগান্তকারী উদ্যোগ বাংলাদেশে কর প্রশাসনকে আধুনিকায়নের পথে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনায় স্বতন্ত্র ও দক্ষ কাঠামো তৈরি হলে ভবিষ্যতে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিও আরও মজবুত হবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button