ড. ইউনূসের বৈঠকেও ফিরল না আস্থা ধুঁকছে পুঁজিবাজার

দেশের পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিনের টানা ধস, নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতা এবং বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির মুখে পড়ে অবশেষে হস্তক্ষেপ করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত রোববার (১১ মে) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অর্থ উপদেষ্টা, বিএসইসি চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন তিনি। সেখানে বাজারে আস্থা ফেরানোর লক্ষ্যে ৫টি নির্দেশনাও দেওয়া হয়।
তবে বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা ছিল, এই বৈঠক বাজারে দৃশ্যমান পরিবর্তন আনবে এবং আস্থার পুনর্জাগরণ ঘটাবে। বাস্তবে দেখা গেছে, বৈঠকের পরদিন সোমবার ঢাকা ও চট্টগ্রাম উভয় স্টক এক্সচেঞ্জেই লেনদেন ছিল তলানিতে, সূচকের খুব সামান্য ঊর্ধ্বগতিও বিনিয়োগকারীদের হতাশা দূর করতে পারেনি। অনেকেই এই বৈঠককে আখ্যা দিয়েছেন ‘ফলস হোপ’ বা মিথ্যা আশার উৎস হিসেবে।
ধারাবাহিক দরপতনের পটভূমি
গত বছরের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর থেকেই দেশের পুঁজিবাজার এক ধারাবাহিক মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীরা হারিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। বাজারে তারল্য সংকট, শেয়ার মূল্যের অব্যাহত পতন এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার অসাড়তা মিলিয়ে আস্থা ফিরে আসার পরিবর্তে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।
প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক: ৫ নির্দেশনা
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বাজার চাঙ্গা করতে যেসব নির্দেশনা দেন, তা হলো:
- সরকারি কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করা।
- দেশি-বিদেশি বড় কোম্পানিকে বাজারে আনা।
- দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
- ব্যাংক নির্ভরতা কমিয়ে বন্ড মার্কেট শক্তিশালী করা।
- বিদেশি বিশেষজ্ঞ এনে তিন মাসে পুঁজিবাজার সংস্কার।
এই নির্দেশনাগুলোর মধ্যে অধিকাংশ পুরোনো ও বহুবার আলোচিত হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। কেবল বিদেশি বিশেষজ্ঞ আনার প্রস্তাবটি কিছুটা নতুন, কিন্তু অংশীজনদের মতে, তা বাস্তবায়নযোগ্য নয়।
আশার বদলে হতাশা
বিনিয়োগকারীদের অনেকেই মনে করেছিলেন, প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে এই বৈঠক পুঁজিবাজারে আশার আলো দেখাবে। কিন্তু সোমবার ডিএসইতে সূচক মাত্র ১৯ পয়েন্ট বাড়লেও লেনদেন ৪০০ কোটির ঘরও ছুঁতে পারেনি। অন্যদিকে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সূচক সামান্য বাড়লেও লেনদেন ছিল মাত্র ৭ কোটি টাকা।
বিআরবি সিকিউরিটিজের সিইও আলমগীর হোসেন বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম, ড. ইউনূস ও অর্থ উপদেষ্টা অর্থনীতির লোক, তাঁরা কিছু বলবেন, কিন্তু বাজার এমন খারাপ যে মানুষ আর আশা রাখতে পারছে না।”
‘ফলস হোপ’ ও ‘সংস্কারের নামে বিভ্রান্তি’
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্কুল অব বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিকসের ডিন অধ্যাপক মোহাম্মদ মুসা প্রশ্ন তোলেন, “এই মিটিং করে কী হয়? যদি কিছু না দিতে পারেন, তাহলে মিটিং করে ভুয়া আশা দেওয়ার মানে কী?”
তিনি বলেন, “সংস্কার শব্দটা এখন রোগ সারানোর অলৌকিক শব্দ হয়ে গেছে, অথচ বাস্তবে সংস্কার কী হবে, কবে হবে—তা কেউ জানে না।”
বিশেষজ্ঞ আনলে লাভ হবে না: সাবেক চেয়ারম্যান
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, “বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞ আনার দরকার নেই। ভালো কোম্পানিগুলোকে প্রণোদনা দিয়ে তালিকাভুক্ত করাতে হবে। কর হারে পার্থক্য আনা যেতে পারে, তবে বিদেশি এক্সপার্ট এনে কোনো লাভ হবে বলে মনে করি না।”
নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি আস্থাহীনতা চরমে
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি দীর্ঘদিন ধরেই সমালোচনার মুখে। দরপতনের মধ্যেও সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা নীরব ভূমিকা পালন করেছেন। এমনকি, বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ অনুযায়ী, শেয়ার লেনদেন করে কমিশনারের বিরুদ্ধে স্বার্থসংঘাতের অভিযোগও উঠেছে।
অবস্থা আরও জটিল হয় যখন বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রশিক্ষণে যোগ দেন—যা কেবল অধস্তন কর্মকর্তাদের জন্য নির্ধারিত ছিল। বিনিয়োগকারীদের মতে, এমন সময়ে তার বিদেশ সফর অগ্রহণযোগ্য এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন।
বিনিয়োগকারীদের ক্ষোভ ও বিক্ষোভ
টানা ক্ষতির মুখে বিনিয়োগকারীরা রাজপথে নেমে আসতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকেই বিএসইসির বর্তমান কমিশনের পদত্যাগ দাবি করেছেন। একজন মার্চেন্ট ব্যাংকের সিইও ব্যঙ্গ করে বলেন, “আমার ডায়রিয়া হলে স্যালাইন না দিয়ে যদি কেউ নাপা দেয়, কাজ হবে না। মার্কেটের মূল সমস্যা ধরতে হবে।”
কী দরকার ছিল, কী হলো না
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে নিচের বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা জরুরি ছিল:
- তারল্য সঙ্কট নিরসনে বাজারে প্রণোদনা প্যাকেজ।
- পুঁজিবাজারে ব্যাংক ও ইনস্টিটিউশনাল ফান্ডের অংশগ্রহণ বাড়ানো।
- বিনিয়োগকারীদের জন্য কর রেয়াত ও উৎসাহমূলক ব্যবস্থা।
- বিনিয়োগ-সুরক্ষা আইন কার্যকর ও বাস্তবায়ন।
- নিয়ন্ত্রক সংস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
আস্থা ফেরাতে চাই সাহসী সিদ্ধান্ত
প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে আশার আলো দেখা গেলেও বাস্তবে কার্যকর কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় বিনিয়োগকারীদের হতাশা আরও গভীর হয়েছে। পুঁজিবাজার এমন একটি জায়গা, যেখানে আস্থা এবং স্থিতিশীলতা ছাড়া প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়। এখন সময় সিদ্ধান্তের—পর্যবেক্ষণ বা প্রতিশ্রুতির নয়।