সরকারি গ্যাসেও ভোক্তাদের ঠকানো: এলপিজি সিলিন্ডারে অতিরিক্ত দাম

সরকারি দামের চেয়ে ২৫ থেকে ৬৫ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) আওতাধীন চার প্রতিষ্ঠানের এলপিজি সিলিন্ডার। নির্ধারিত ৮২৫ টাকার পরিবর্তে বাজারে গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৩৫০ টাকায়। বিপিসির এক অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। তবে এসব অনিয়ম বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপের ঘাটতি থাকায় ভোক্তারা বছরের পর বছর ধরে ঠকেই যাচ্ছেন।
সরকারি গ্যাস, বেসরকারি দাম
বিপিসির চারটি প্রতিষ্ঠান—পদ্মা, মেঘনা, যমুনা এবং স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (এসএওসিএল)—সরকারি মূল্য নির্ধারিত এলপিজি সিলিন্ডার সরবরাহ করে। কোম্পানিগুলো পরিবেশকদের কাছে ১২.৫ কেজি সিলিন্ডার বিক্রি করে ৭৮৪ টাকায়। পরিবহন ও পরিচালন খরচ মিলিয়ে ভোক্তাদের কাছে সর্বোচ্চ দাম হওয়ার কথা ৮২৫ টাকা।
কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারেই উল্টো। চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্থানে খুচরা বিক্রেতারা এই গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করছেন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৩৫০ টাকায়। যা সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে প্রায় ৫০০ টাকার বেশি।
পরিবেশকদের অজুহাত: সরবরাহ ঘাটতি ও খরচ
চট্টগ্রাম নগরের বাটালি রোডের পরিবেশক শাহ আলম বলেন, “যতটা গ্যাস পাই, তা দিয়ে দোকানভাড়া তোলা সম্ভব হয় না। পরিবহন খরচও বেড়েছে।” পাহাড়তলীর আরেক পরিবেশক মো. ফজলু বলেন, “চাহিদার তুলনায় কোম্পানিগুলো পর্যাপ্ত গ্যাস দেয় না, তাই নির্ধারিত দামে বিক্রি করা যায় না।”
এলপি গ্যাস পরিবেশক সমিতি চট্টগ্রামের সভাপতি খোরশেদুর রহমানও বলছেন, “চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় বাধ্য হয়েই বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।”
নজরদারির অভাবই মূল কারণ
ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বিইআরসি (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন) এবং বিপিসি নির্ধারিত মূল্যে বিক্রির বিষয়টি তদারকি করছে না বলেই দাবি করেছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম।
তিনি বলেন, “বিইআরসি ও বিপিসির যথাযথ তদারকির অভাবে পরিবেশকেরা বাড়তি দাম নিচ্ছেন। এতে সরকারি গ্যাস বিক্রি করেও ভোক্তারা উপকৃত হচ্ছেন না।”
সরকারী গ্যাসের নামে বেসরকারি খালাস
বিপিসি চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান স্বীকার করেছেন যে, অনেক ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দাম নেওয়া হচ্ছে এবং সরকারি গ্যাস বেসরকারি সিলিন্ডারে ভরে বিক্রির অভিযোগও পাওয়া গেছে। তিনি জানান, “আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে এসব অনিয়ম বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
বিপিসির তদন্ত প্রতিবেদন যা বলছে
গত ৪ মে জমা দেওয়া এক তদন্ত প্রতিবেদনে বিপিসি নিজেই স্বীকার করেছে যে, বর্তমান পরিবেশক নিয়োগ ও বিপণন নীতিমালা পুরোনো এবং হালনাগাদ করা প্রয়োজন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সরকারি সিলিন্ডারের দাম (৮২৫ টাকা) আর বেসরকারি সিলিন্ডারের দাম (১,৪৩১ টাকা)–এর মধ্যে বিশাল ব্যবধান থাকায় বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে।
সমাধানের প্রস্তাব: সরাসরি বিক্রি
তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, “ডিপো বা বিক্রয় অফিসের তত্ত্বাবধানে গ্রাহক কার্ড চালু করে সরাসরি ভোক্তার কাছে গ্যাস বিক্রির ব্যবস্থা নিতে হবে।” এর মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগী বাদ গিয়ে ভোক্তা সরাসরি সরকারের কাছ থেকে নির্ধারিত দামে গ্যাস পেতে পারেন।
বিপিসির গ্যাস বিক্রির পরিসংখ্যান
বিপিসির তথ্যানুযায়ী, চার কোম্পানির অধীনে এলপি গ্যাস পরিবেশকের সংখ্যা ৩ হাজার ১০১। গত পাঁচ বছরে এই চার কোম্পানি মোট বিক্রি করেছে ৫ কোটি ২২ লাখ ৩০ হাজার কেজি এলপি গ্যাস।
সরকারি গ্যাস বিক্রি করে বিপিসি লাভবান হলেও, সাধারণ ভোক্তা কার্যত লাভের বাইরে। সরকারের নির্ধারিত মূল্য নীতিকে অকার্যকর করে দিয়েছে বাজারের অনিয়ম ও দুর্বল তদারকি ব্যবস্থা। ফলে এই খাতে নীতিমালার সংস্কার, কার্যকর নজরদারি এবং সরাসরি ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রির উদ্যোগ ছাড়া সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।