ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে কেন ক্ষুব্ধ বিজেপি সমর্থকরা

সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার মধ্যে হঠাৎ যুদ্ধবিরতি ঘোষণায় স্বস্তি ফিরেছে দক্ষিণ এশিয়ার জনমনে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে ভারতের শাসকদল বিজেপির সমর্থক ও হিন্দুত্ববাদী অংশে দেখা দিয়েছে প্রবল ক্ষোভ ও হতাশা। যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ সমাধান তারা দেখতে চায়নি। বরং তাদের প্রত্যাশা ছিল একটি ‘চূড়ান্ত সামরিক বিজয়’—যা পাকিস্তান সমস্যার ‘একঘাটে জল’ টেনে আনবে।
এই প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করবে কেন বিজেপি ও তাদের ঘনিষ্ঠ মহলের অনেকেই যুদ্ধবিরতিকে ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির ‘পিছু হটা’ হিসেবে দেখছে।
বিজেপির যুদ্ধপ্রবণ বার্তা: ‘যাচনা ন্যাহি, রণ হোগা’
গত সপ্তাহে উত্তেজনা যখন চরমে, তখন বিজেপি তাদের এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টে একটি বার্তা প্রকাশ করে:
“যাচনা ন্যাহি, আব রণ হোগা”—অর্থাৎ, “আর অনুরোধ নয়, এবার যুদ্ধ হবে।”
সঙ্গে ছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটি সামরিক পোশাকে তোলা ছবি। এই পোস্টটি রীতিমতো যুদ্ধ-প্রস্তুতির ইঙ্গিত দিয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় জাতীয়তাবাদী মহলে তা ব্যাপক সাড়া ফেলে।
তবে ওই পোস্টের ২৪ ঘণ্টার মাথায় হোয়াইট হাউসের বিবৃতি পাল্টে দেয় পরিস্থিতি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন, ভারত ও পাকিস্তান একটি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। এই ঘোষণায় সীমান্তের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও বিজেপি সমর্থকদের অনেকে হতাশায় ভেঙে পড়েন।
‘আমরা হেরে গেলাম’, বলছেন হিন্দুত্ববাদীরা
যুদ্ধবিরতিকে তারা দেখছেন একরকম আত্মসমর্পণ হিসেবে। বিজেপি-ঘনিষ্ঠ অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়াগুলোর মধ্যে অন্যতম শেফালি বৈদ্যের। তিনি লিখেছেন—
“স্পষ্টতই এগিয়ে থাকার পরও যখন আপনি সরে দাঁড়ান, তা কিছুটা হতাশাজনক মনে হয়।”
বিজেপির ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত শক্তি সিং বলছেন,
“পাকিস্তানে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করেছিল, দাউদ ইব্রাহিম বা হাফিজ সাঈদের বিরুদ্ধে ভারত সেই রকম কিছুই করতে পারেনি।”
তার মতে, যুদ্ধবিরতির মানেই হয় না যতক্ষণ এসব জঙ্গি জীবিত রয়েছে।
গুয়াহাটিভিত্তিক বিজেপি সদস্য মুন তালুকদার বলছেন,
“পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর দখলই হওয়া উচিত ছিল। যদি তা হতো, ভারত প্রমাণ করতে পারত যে আমরা দুর্বল নই। যুদ্ধবিরতিতে সে সুযোগ নষ্ট হয়েছে।”
ট্রাম্পের হস্তক্ষেপে ক্ষুব্ধ ভারতীয় জনতা
সবচেয়ে বেশি রাগের কারণ—এই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা ভারত নয়, দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
বিজেপি নেতা ও সাংবাদিক স্বপন দাশগুপ্ত লিখেছেন,
“ট্রাম্প হঠাৎ করেই আবির্ভূত হয়ে রায় দিয়ে দিলেন। এটা ভারতীয়দের ভালো লাগেনি।”
এমনকি রিপাবলিক মিডিয়ার অর্ণব গোস্বামী তো বলেই ফেলেছেন,
“ট্রাম্প জানেন না এখানে কী ঘটছে। কাশ্মীর ইস্যু তাঁর আয়ত্তের বাইরে।”
বিজেপি-ঘনিষ্ঠ মহলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে—এই হস্তক্ষেপ ভবিষ্যতে কাশ্মীর নিয়ে আরও আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করবে।
পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রিও সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু
‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে ভারতীয় সামরিক অভিযানের মুখ্য মুখ ছিলেন পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্র। কিন্তু যুদ্ধবিরতির পর তিনিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভয়ংকর ট্রলের শিকার হন।
তার মেয়ের পেশাগত জীবন, পারিবারিক ছবি ছড়িয়ে তাকে অপমান করা হয়। এমনকি মিশ্রী তার এক্স অ্যাকাউন্টের গোপনীয়তা সেটিংস পাল্টাতে বাধ্য হন।
‘চূড়ান্ত সমাধান’-এর আশাভঙ্গ
বিজেপি সমর্থকদের একটি বড় অংশ বিশ্বাস করেছিল, মোদির সরকার এবারই পাকিস্তান সমস্যার স্থায়ী সমাধান করবে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (RSS) ঘনিষ্ঠ ছাত্র সংগঠনের নেতা সায়ন লাহিড়ী বলছেন—
“সাধারণ হিন্দুরা আশা করেছিল জিহাদবাদ নির্মূলের একটি স্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কিন্তু সেটি হয়নি।”
তিনি আরও দাবি করেন,
“আমরা চাই পাকিস্তানকে বিশ্বমানচিত্র থেকেই মুছে দেওয়া হোক।”
এই উগ্র মনোভাবই আসলে মোদি সরকারের একাংশের আগ্রাসী নীতির প্রতিফলন, যা যুদ্ধবিরতিতে এসে থেমে গেছে—এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সংকট মোদির ভাবমূর্তি ও ভোটব্যাংকে
এই পরিস্থিতি মোদি সরকারের জন্যও অস্বস্তিকর। তারা একদিকে শান্তির বার্তা দিচ্ছে, অন্যদিকে তাদের নিজস্ব সমর্থকেরাই সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছে।
২০২৫ সালের জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে যুদ্ধকালীন জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে ভোটব্যাংক কুড়ানোর চেষ্টা থাকলেও যুদ্ধবিরতির ফলে সেই প্রচারণা ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
শান্তি না যুদ্ধ—কে ঠিক, কে ভুল?
সাধারণ নাগরিকদের জন্য যুদ্ধবিরতি মানে জীবন বাঁচা, ঘরবাড়ি রক্ষা পাওয়া। কিন্তু বিজেপির উগ্র জাতীয়তাবাদী ঘরানার কাছে যুদ্ধ ছিল একধরনের ‘সম্মানের লড়াই’। সেই লড়াই থেমে যাওয়ায় তাদের কাছে এটি মোদি সরকারের ‘দুর্বলতা’ হিসেবে ধরা পড়েছে।
যদিও আন্তর্জাতিক মহল ও মানবিক সংগঠনগুলো ভারতের শান্তিপূর্ণ অবস্থানের প্রশংসা করেছে, তবু দেশের ভেতরে জাতীয়তাবাদী চাপ মোদির সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাজির হয়েছে।