
লা লিগার চলতি মৌসুমের সমাপ্তি এখনও হয়নি, এর মধ্যেই ফুটবল বিশ্বে এক বড় ধরনের পরিবর্তনের খবর সামনে এসেছে। বহুদিনের গুঞ্জন অবশেষে সত্যি হয়ে উঠেছে—রিয়াল মাদ্রিদের বর্তমান প্রধান কোচ কার্লো আনচেলত্তি ব্রাজিল জাতীয় দলের নতুন হেড কোচ হিসেবে দায়িত্ব নিচ্ছেন। ৬৫ বছর বয়সী এই অভিজ্ঞ ইতালীয় কোচ আগামী ২৬ মে ব্রাজিল দলের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন বলে জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে, রিয়াল মাদ্রিদের ডাগআউটে আসছেন আরেক পরিচিত মুখ—জাবি আলোনসো। স্প্যানিশ মিডিয়ার দাবি অনুযায়ী, রিয়ালের সাবেক তারকা এবং বায়ার লেভারকুজেনের বর্তমান কোচ আলোনসো রিয়ালের সাথে তিন বছরের চুক্তিতে সম্মত হয়েছেন। ফুটবল বিশ্লেষক ফাব্রিজিও রোমানো নিশ্চিত করেছেন, রিয়াল মাদ্রিদ ও আলোনসোর মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে, যার আওতায় আলোনসো তার নিজস্ব কোচিং স্টাফও গঠন করবেন।
আনচেলত্তির বিদায়: সম্ভাবনার মধ্যেই বাস্তবতা
চলতি মৌসুমে রিয়ালের পারফরম্যান্স অনেকটা মিশ্র। দলের পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতার অভাব ছিল স্পষ্ট। লা লিগা ও কোপা দেল রে—দুই প্রতিযোগিতাতেই শিরোপার দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছে দলটি। ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নস লিগে শেষ চারের আগে বিদায় নিতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে ক্লাবের ভেতরে আনচেলত্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে।
রিয়ালের বোর্ড এবং ভক্তরা দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের লক্ষ্য স্থির করে নতুন পরিকল্পনার দিকে এগোতে চাইছে। ফলে আনচেলত্তির মতো সফল কোচের বিদায় হলেও সেটিকে ভবিষ্যতের বিনিয়োগ হিসেবে দেখছে অনেকেই।
আনচেলত্তি ২০২۱ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে রিয়ালের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন এবং তার অধীনে ক্লাবটি লা লিগা, চ্যাম্পিয়নস লিগ, সুপার কাপসহ একাধিক শিরোপা ঘরে তুলেছে। তবে শেষ দুই মৌসুমে রিয়ালের শিরোপা-খরা ও দলীয় দুর্বল পারফরম্যান্স তার বিদায়ের পেছনে প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তিনি বিদায় উপলক্ষে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন, “রিয়াল মাদ্রিদে কাজ করাটা আমার জন্য সম্মানের। আমি বিশ্বাস করি, এই ক্লাবের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। আমি শুনেছি জাবি আসছে—সে একজন দক্ষ ও চতুর কোচ। তার হাতে রিয়াল নিরাপদ থাকবে।”
ব্রাজিল জাতীয় দলে আনচেলত্তির নতুন অধ্যায়
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোচিং ক্যারিয়ারে এবারই প্রথমবারের মতো প্রবেশ করছেন কার্লো আনচেলত্তি। দীর্ঘ ক্লাব ক্যারিয়ারে তিনি ইতালির এসি মিলান, ইংল্যান্ডের চেলসি, ফ্রান্সের পিএসজি, জার্মানির বায়ার্ন মিউনিখ এবং স্পেনের রিয়াল মাদ্রিদের মতো শীর্ষ ক্লাবে কোচিং করেছেন।
ব্রাজিল ফুটবল কনফেডারেশন (CBF) আনচেলত্তির অভিজ্ঞতা ও বিশ্বজুড়ে তার পরিচিতিকে গুরুত্ব দিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কোচিং অস্থিরতা ও পারফরম্যান্সে ভাটা থাকায় ব্রাজিল দলের জন্য এটি এক নতুন সূচনা বলে বিবেচিত হচ্ছে।
ব্রাজিল দল ২০২৬ বিশ্বকাপের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে এবং আনচেলত্তির নেতৃত্বে তারা আবারও বিশ্বসেরা হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে। ইতিমধ্যেই কাকা, রোনালদো, কাফুর মতো সাবেক ব্রাজিলিয়ান ফুটবলাররা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন।
আলোনসোর আগমন: নতুন প্রত্যাশার প্রতিচ্ছবি
জাবি আলোনসো, রিয়াল মাদ্রিদের সাবেক মিডফিল্ডার, যিনি ২০০৯-২০১৪ সাল পর্যন্ত ক্লাবে খেলেছেন। রিয়াল ছাড়ার পর বায়ার্ন মিউনিখে খেলার অভিজ্ঞতা এবং এরপর কোচ হিসেবে রিয়াল সোসিয়েদাদের যুবদল ও বর্তমানে বায়ার লেভারকুজেনে তার সফল কোচিং ক্যারিয়ার তাকে পরিণত করেছে ফুটবল বিশ্বের এক উদীয়মান কোচে।
২০২2-২৩ মৌসুমে লেভারকুজেনকে ইউরোপা লিগের সেমিফাইনালে তুলেছিলেন এবং বুন্দেসলিগাতেও দলকে শীর্ষ তিনে নিয়ে যান। আধুনিক ট্যাকটিকস, আক্রমণাত্মক ফুটবল এবং তরুণ খেলোয়াড়দের নিয়ে কাজ করার দক্ষতায় আলোনসো ইতোমধ্যেই কোচ হিসেবে নিজের নাম প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
রিয়াল মাদ্রিদ তাকে দলে টেনে আনায় বোঝা যায়, ক্লাব ভবিষ্যতের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর গ্রীষ্মকালীন দলবদলে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। ক্লাব বিশ্বকাপে তার অধীনে দলকে মাঠে দেখা যাবে, যা হবে তার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ।
আনচেলত্তি-আলোনসো: গুরু-শিষ্যের পুনর্মিলন
আনচেলত্তির অধীনেই খেলোয়াড় হিসেবে জাবি আলোনসোর রিয়াল ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ হয়। সেই শিষ্য এবার গুরুর জায়গায় বসছেন, যা ফুটবল ইতিহাসে এক বিরল এবং আবেগঘন ঘটনা। ফুটবল বিশ্ব অপেক্ষা করছে—জাবি কীভাবে গ্যালাক্টিকোদের নেতৃত্ব দেবেন এবং আনচেলত্তি কীভাবে ব্রাজিলকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরবেন।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ ও ব্রাজিল—উভয় দলই নতুন অধ্যায়ের সূচনায় পা রাখল। একদিকে রিয়াল তরুণ, উদ্যমী এবং আধুনিক কৌশলে বিশ্বাসী কোচকে নিয়ে এগোচ্ছে; অন্যদিকে ব্রাজিল আস্থা রেখেছে এক বিশ্বজয়ী কোচের অভিজ্ঞতায়।
আলোনসোর সামনে রিয়ালের তরুণ প্রতিভা, মিডফিল্ডের ভারসাম্য এবং চ্যাম্পিয়নস লিগে সফল হওয়ার চ্যালেঞ্জ থাকবে। অন্যদিকে আনচেলত্তির জন্য থাকবে আন্তর্জাতিক ফুটবলের ভিন্নধর্মী চ্যালেঞ্জ এবং বিশ্বকাপ জয়ের প্রত্যাশা।
বিশ্ব ফুটবলপ্রেমীরা তাই মুখিয়ে রয়েছেন এই দুই বড় রদবদলের ফলাফল দেখার জন্য। কে কতটা সফল হবেন, সেটি সময়ই বলে দেবে।