অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে প্রবাসী আয়ে নতুন ইতিহাস, সৌদি আরব শীর্ষে

বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য প্রবাসীদের রেমিট্যান্স বরাবরই একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। সেই রেমিট্যান্সেই এবার ভাঙল অতীতের সব রেকর্ড। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ৭ মে পর্যন্ত দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ২৫ দশমিক ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স প্রবাহ হিসেবে রেকর্ড গড়েছে।
আগের রেকর্ড ভেঙে নতুন উচ্চতায় রেমিট্যান্স
এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। এবার সেটি ছাড়িয়ে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী ২০২৫ সালের ৭ মে পর্যন্ত রেমিট্যান্স এসেছে ২৫.২৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রবাসীদের আস্থা ও সরকার ঘোষিত বিভিন্ন প্রণোদনার কারণে এ রেকর্ড আয় সম্ভব হয়েছে।
৭ দিনে ৭৩৫ মিলিয়ন ডলার, প্রবৃদ্ধি ২২.৩%
২০২৫ সালের মে মাসের প্রথম সাত দিনেই প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ৭৩৫ মিলিয়ন ডলার। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২২ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি। গত বছরের এই সময়ে এসেছিল ৬০১ মিলিয়ন ডলার। ৭ মে একদিনেই এসেছে ১১০ মিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, “রেমিট্যান্স বেড়ে যাওয়ার পেছনে অবৈধ হুন্ডি বন্ধে নজরদারি, ব্যাংকিং চ্যানেল সহজ করা এবং প্রণোদনার হার বৃদ্ধি—সবই কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।”
মাসের হিসাবে মার্চে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স
২০২৫ সালের মার্চ মাসে প্রবাসী আয় এসেছে সর্বোচ্চ ৩২৯ কোটি ৫৬ লাখ মার্কিন ডলার, যা দেশের ইতিহাসে এক মাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স। এপ্রিলেও ঈদের প্রভাবে আয় ছিল রেকর্ডের কাছাকাছি—২৭৫ কোটি ১৯ লাখ ৪০ হাজার ডলার, যা মাসিক হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
কোন দেশ থেকে কত রেমিট্যান্স এসেছে?
বিদায়ী এপ্রিল মাসে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে সৌদি আরব থেকে—৪৯ কোটি ১৪ লাখ ডলার। এরপর:
- সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE): ৩৭ কোটি ২১ লাখ ডলার
- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র: ৩৩ কোটি ৭ লাখ ডলার
- যুক্তরাজ্য (UK): ২৯ কোটি ৪১ লাখ ডলার
- মালয়েশিয়া: ২১ কোটি ৯ লাখ ডলার
- কুয়েত: ১৬ কোটি ২৭ লাখ ডলার
- ইতালি: ১৫ কোটি ৫ লাখ ডলার
- ওমান: ১৪ কোটি ৮৩ লাখ ডলার
- সিঙ্গাপুর: ১১ কোটি ৮৫ লাখ ডলার
- কাতার: ১০ কোটি ৪২ লাখ ডলার
এ ছাড়া আরও অনেক দেশ থেকে উল্লেখযোগ্য অঙ্কে রেমিট্যান্স এসেছে। উদাহরণস্বরূপ:
- বাহরাইন: ৬ কোটি ৪৫ লাখ
- ফ্রান্স: ৩ কোটি ১৭ লাখ
- দক্ষিণ আফ্রিকা: ২ কোটি ৮৮ লাখ
- দক্ষিণ কোরিয়া: ২ কোটি ৪৪ লাখ
- কানাডা: ২ কোটি ৩৭ লাখ
- জার্মানি: ১ কোটি ৬৯ লাখ
- অস্ট্রেলিয়া: ১ কোটি ৬৩ লাখ
- গ্রিস: ১ কোটি ৪৭ লাখ
- জর্ডান: ১ কোটি ৪৪ লাখ
- মালদ্বীপ: ১ কোটি ২৫ লাখ
- স্পেন ও পর্তুগাল: প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ করে
- লেবানন: ৬৮ লাখ ৫০ হাজার
- পোল্যান্ড: ৫৯ লাখ
- সুইডেন: ৫৫ লাখ
- জাপান: ৮৫ লাখ
- ফিনল্যান্ড: ৩৮ লাখ
- অন্যান্য দেশ থেকে এসেছে: ৪ কোটি ২১ লাখ ৮০ হাজার ডলার
রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কারণ কী?
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রবাসীদের আয় বেড়ে যাওয়ার কারণগুলো হলো:
- অবৈধ হুন্ডি চ্যানেল নিয়ন্ত্রণ: সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়াকড়ি নজরদারির ফলে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠানো কমেছে।
- প্রণোদনা সুবিধা: সরকার রেমিট্যান্সে ২.৫ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে, যা প্রবাসীদের বৈধ পথে টাকা পাঠাতে উৎসাহিত করছে।
- ইসলামী ও আরব দেশগুলোতে চাকরির বাজার সম্প্রসারণ: সৌদি আরব, কুয়েত ও কাতারে নতুন চুক্তিতে হাজার হাজার শ্রমিক গিয়েছেন।
- ডলার রেট আকর্ষণীয় হওয়া: ব্যাংক ও এক্সচেঞ্জ হাউজে প্রতিযোগিতামূলক হারে ডলার দেওয়া হচ্ছে।
রেমিট্যান্সের প্রভাব কী হতে পারে?
রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়লে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মজবুত হয়। এতে আমদানি ব্যয় মেটানো সহজ হয়, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং টাকার মান স্থিতিশীল থাকে।
অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, “যেহেতু বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ এবং আমদানি ব্যয় বাড়ছে, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করছে।”
চ্যালেঞ্জও আছে
তবে আশার পাশাপাশি কিছু সতর্কবার্তাও দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, রেমিট্যান্স প্রবাহ দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখতে হলে—
- দক্ষ শ্রমিক পাঠানো
- বৈধ চ্যানেলের প্রসার
- বিদেশে অবৈধ অভিবাসন বন্ধে ব্যবস্থা
- রেমিট্যান্স বিনিয়োগবান্ধব খাতে ব্যবহারের উদ্যোগ
এগুলো নিশ্চিত করতে হবে।