জাতীয়

স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে: প্রধান উপদেষ্টা

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের জন্য দোষারোপের রাজনীতি বাদ দিয়ে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের সীমাবদ্ধতা ও ঘাটতি সত্ত্বেও জনগণের কাছে মানসম্মত সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব—যদি আন্তরিকতা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকে।

সোমবার (১২ মে) দুপুরে ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে আয়োজিত প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত সিভিল সার্জন কনফারেন্স-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি। স্বাস্থ্য খাতের বিকাশ এবং জেলা পর্যায়ের বাস্তব সমস্যা ও সমাধান খোঁজার লক্ষ্যে এই দুই দিনব্যাপী সম্মেলন শুরু হয়।

“দোষ দিয়ে নয়, সমাধানে যেতে হবে”—একটি পরিবর্তনের বার্তা

ড. ইউনূস বলেন,

“আমরা প্রায়ই স্বাস্থ্যসেবার দুর্বলতা নিয়ে একে অপরকে দোষারোপ করি। কিন্তু এতে কোনও সমাধান আসে না। বরং সবাই মিলে বসলে অনেক প্রশ্ন ও সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এই সম্মেলনের মাধ্যমে আশা করি আমরা সুফল পাবো।”

তিনি আরও যোগ করেন যে, স্বাস্থ্য খাতের অভাব ও ঘাটতি থাকলেও সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে অনেক ভালো কিছু করা সম্ভব। এটি প্রমাণ করেছে অতীতের নানা জরুরি সময় ও সংকট মোকাবিলার অভিজ্ঞতা।

‘স্বাস্থ্যসেবা রাজনীতির বিষয় নয়’—সরাসরি বার্তা রাজনৈতিক মহলের প্রতি

ড. ইউনূস এক গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যে বলেন,

“স্বাস্থ্যসেবা রাজনীতির বিষয় নয়। এখানে দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে। এটা এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে কাঠামো বা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি নয়, বরং মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”

এ বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে স্পষ্ট বার্তা পাঠায় যে, স্বাস্থ্যখাতকে দলীয় স্বার্থের বাইরে রেখে গঠনমূলক সহযোগিতা এবং পরিকল্পনা দরকার।

জেলা পর্যায়ের চ্যালেঞ্জ জানতে চায় সরকার

সিভিল সার্জন সম্মেলনে দেশের সব জেলার সিভিল সার্জন ও জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তাদের কাছ থেকে স্বাস্থ্যসেবায় মাঠপর্যায়ের চ্যালেঞ্জ ও বাস্তব অভিজ্ঞতা শুনতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টা বলেন,

“এই সম্মেলন শুধু নীতিনির্ধারকদের বক্তব্যের জায়গা নয়, বরং বাস্তব চিত্র তুলে ধরার জন্য একটি মঞ্চ।”

তিনি মনে করেন, এ ধরনের প্রত্যক্ষ আলোচনা থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা বেরিয়ে আসবে, যা ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হবে।

স্বাস্থ্যখাতে ঘাটতি সত্ত্বেও ইতিবাচক পরিবর্তনের সুযোগ

ড. ইউনূস বলেন,

“আমাদের স্বাস্থ্যখাতে অভাব-অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু সেটি অজুহাত হতে পারে না। সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ভালো কিছু করা সম্ভব। দরকার শুধু আন্তরিকতা ও কার্যকর পরিকল্পনা।”

তিনি আরও বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার তাদের সাংবিধানিক সীমারেখার মধ্যেই কাজ করছে। তার মানে এই নয় যে আমরা স্থবির হয়ে থাকবো। যে অবস্থানে আমরা আছি, সেখান থেকেই সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।”

স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে প্রথমবারের মতো সম্মেলন: ইতিহাসের এক মাইলফলক

এই সম্মেলন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবার অনুষ্ঠিত সিভিল সার্জন কনফারেন্স, যেখানে জেলা পর্যায়ের শীর্ষ স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের নিয়ে সরাসরি আলোচনা হয়। স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন, দুর্বলতা, প্রয়োজনীয়তা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে অংশগ্রহণমূলক এ উদ্যোগকে ইতিবাচকভাবে দেখছে বিশেষজ্ঞ মহল।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই সম্মেলন থেকে পাওয়া তথ্য ও সুপারিশের ভিত্তিতে আগামী মাসেই একটি সংক্ষিপ্ত সংস্কার কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হবে।

বিশেষজ্ঞদের মত: সম্মিলিত সিদ্ধান্তই পারে স্বাস্থ্যব্যবস্থা বদলাতে

দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সাবেক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মনে করেন, এই সম্মেলন শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতার নাম নয়, বরং এটি বাস্তবভিত্তিক নীতিনির্ধারণের জন্য একটি সুযোগ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. ফারহানা হক বলেন,

“মাঠপর্যায়ের সিভিল সার্জনরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি। তারা প্রতিদিন রোগী, বাজেট, ওষুধ ও লোকবল সংকটের বাস্তব চিত্র দেখেন। তাদের অভিজ্ঞতা ছাড়া উন্নয়ন পরিকল্পনা হবে একপেশে।”

স্বাস্থ্যখাতের কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ ও প্রত্যাশা

বর্তমানে দেশের স্বাস্থ্যখাতে যেসব বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

  • পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও নার্সের ঘাটতি
  • জেলা পর্যায়ে বিশেষায়িত চিকিৎসার অভাব
  • ওষুধ সরবরাহ ব্যবস্থার জটিলতা
  • স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে অনুপস্থিতি ও দুর্নীতি
  • জনগণের মধ্যে সচেতনতার অভাব

এই সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি বাজেট বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার, ডিজিটাল হেলথ রেকর্ড, জবাবদিহিমূলক কাঠামো এবং রোগীসেবা মনিটরিং।

সম্মেলনের সম্ভাব্য ফলাফল ও ভবিষ্যৎ উদ্যোগ

এই সম্মেলনের মাধ্যমে একটি জেলা স্বাস্থ্য উন্নয়ন রোডম্যাপ তৈরির আশা করছেন আয়োজকেরা। সম্মেলনের শেষ দিনে জেলার প্রতিনিধিরা লিখিতভাবে তাদের সুপারিশ তুলে ধরবেন। এরপর তা বিশ্লেষণ করে এক মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

এছাড়াও জেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য বাজেট ব্যবস্থাপনা, দ্রুত চিকিৎসক নিয়োগ প্রক্রিয়া, এবং মোবাইল ক্লিনিক সেবা সম্প্রসারণসহ বেশ কিছু উদ্যোগ ঘোষণা করা হতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button