অর্থনীতি

তিন মাসের মধ্যে পুঁজিবাজারের সংস্কার, আসছে বিদেশি এক্সপার্ট

দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং আন্তর্জাতিক মানের সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিন মাসের মধ্যে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই সংস্কার প্রক্রিয়ায় বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। রোববার (১১ মে) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে এক বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এ তথ্য জানান।

সংস্কারের রূপরেখা

প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, প্রধান উপদেষ্টা পুঁজিবাজারের আধুনিকায়ন ও সংস্কারের জন্য আগামী তিন মাসের মধ্যে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন। এই বিশেষজ্ঞরা পুঁজিবাজারের কাঠামোগত দুর্বলতা চিহ্নিত করবেন এবং আন্তর্জাতিক মানের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রবর্তনে সহায়তা করবেন। এছাড়া, শেয়ারবাজারে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত এবং কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।

বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “শেয়ারবাজারকে এমন অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে যেন মানুষ আস্থা ফিরে পায়। এটি যেন লুটেরাদের আড্ডাখানায় পরিণত না হয়।” তিনি জোর দিয়ে বলেন, গত কয়েক দশকে শেয়ারবাজারে যারা লুটপাটে জড়িত ছিল, তাদের বিচারের আওতায় না আনলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে না।

বেসরকারি ও সরকারি কোম্পানির জন্য প্রণোদনা

পুঁজিবাজারের গতিশীলতা বাড়াতে বেসরকারি খাতের বড় কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করতে উৎসাহিত করার জন্য প্রণোদনা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এই প্রণোদনার মাধ্যমে দেশীয় বড় কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে অংশগ্রহণে আগ্রহী করে তোলা হবে। এটি বাজারের তরলতা বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে বলে মনে করা হচ্ছে।

এছাড়া, সরকারের মালিকানাধীন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শেয়ার কমিয়ে তাদের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকারি অংশীদারিত্বে পরিচালিত কোম্পানিগুলোর শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য উন্মুক্ত হবে, যা বাজারের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ

প্রধান উপদেষ্টা আরও নির্দেশ দিয়েছেন, বড় ধরনের ঋণ প্রয়োজন এমন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাংক ঋণের উপর নির্ভরতা কমিয়ে পুঁজিবাজার থেকে বন্ড ও ইক্যুইটির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহে উৎসাহিত করতে হবে। এই পদক্ষেপ ব্যাংকিং খাতের উপর চাপ কমানোর পাশাপাশি পুঁজিবাজারকে আরও শক্তিশালী করবে।

বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান তাদের মূলধনের জন্য ব্যাংক ঋণের উপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরতা কমিয়ে পুঁজিবাজার থেকে তহবিল সংগ্রহের প্রবণতা বাড়ানো গেলে বাজারের গভীরতা এবং স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে।

বিদেশি বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা

পুঁজিবাজারের সংস্কারে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়োগের সিদ্ধান্ত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই বিশেষজ্ঞরা আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারের সর্বোত্তম অনুশীলন (বেস্ট প্র্যাকটিসেস) প্রয়োগে সহায়তা করবেন। তারা বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রণ কাঠামো, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ প্রদান করবেন।

বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে সংস্কার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে এবং বাজারের প্রতি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া, বিদেশি বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালিত হলে স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও আস্থা বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের বর্তমান চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের পুঁজিবাজার দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। বাজারে স্বচ্ছতার অভাব, অনিয়ম, এবং কারসাজির অভিযোগ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষুণ্ণ করেছে। বিশেষ করে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি বড় কোম্পানির শেয়ার কারসাজি এবং আর্থিক অনিয়মের ঘটনা বাজারের সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

এছাড়া, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম, যা বাজারের তরলতা এবং গভীরতার উপর প্রভাব ফেলছে। বেসরকারি খাতের বড় কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে অনীহা প্রকাশ করে, যা বাজারের প্রসারে বাধা সৃষ্টি করছে।

বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বিনিয়োগে মন্দার কারণে প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে পুঁজিবাজারের সংস্কার অর্থনীতির স্থিতিশীলতা এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সংস্কারের সম্ভাব্য প্রভাব

প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা বাস্তবায়িত হলে পুঁজিবাজারে বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। প্রথমত, বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় বাজারের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শক্তিশালী হবে, যা অনিয়ম এবং কারসাজি প্রতিরোধে সহায়ক হবে। দ্বিতীয়ত, বেসরকারি ও সরকারি কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্তি বৃদ্ধি পেলে বাজারের তরলতা এবং বিনিয়োগের সুযোগ বাড়বে।

তৃতীয়ত, ব্যাংক ঋণের উপর নির্ভরতা কমিয়ে পুঁজিবাজার থেকে তহবিল সংগ্রহের প্রবণতা বৃদ্ধি পেলে ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি হ্রাস পাবে এবং পুঁজিবাজার আরও শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড়াবে। সবশেষে, সংস্কারের মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে এলে দেশীয় ও বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে, যা অর্থনীতির সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

সরকারের অন্যান্য উদ্যোগ

পুঁজিবাজার সংস্কারের পাশাপাশি সরকার অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আর্থিক খাতে সংস্কার, ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতি, এবং বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। এই সকল উদ্যোগের মাধ্যমে সরকার অর্থনীতিকে স্থিতিশীল এবং গতিশীল করার চেষ্টা করছে।

বিশেষ করে, পুঁজিবাজারের সংস্কার ফোকাস গ্রুপ এবং তদন্ত কমিটির মাধ্যমে বাজারের অনিয়ম এবং দুর্নীতি তদন্তের কাজ চলছে। এই কমিটিগুলো বিগত সময়ের অনিয়ম চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সহায়তা করছে।

উপসংহার

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে পুঁজিবাজার সংস্কারের এই উদ্যোগ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তিন মাসের মধ্যে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় সংস্কার সম্পন্ন করতে পারলে পুঁজিবাজারে সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরে আসবে। এই সংস্কার শুধু বাজারের স্থিতিশীলতাই নিশ্চিত করবে না, বরং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button