অর্থনীতি

শেয়ারবাজার যেন লুটেরাদের আড্ডাখানা না হয়: প্রধান উপদেষ্টা

শেয়ারবাজারের উপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, দেশের শেয়ারবাজার যেন লুটেরাদের আড্ডাখানায় পরিণত না হয়, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।

রোববার (১১ মে) ঢাকার গুলশানে নিজ বাসভবন ‘যমুনা’য় অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে তিনি এ মন্তব্য করেন। বৈঠকে সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারের লাগাতার দরপতন এবং বিনিয়োগকারীদের ক্ষোভের প্রেক্ষিতে ‘পুঁজিবাজার উন্নয়ন ও শক্তিশালীকরণ’ ইস্যুতে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, প্রধান উপদেষ্টার অর্থ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ।

আস্থা ফিরিয়ে আনতে জরুরি সংস্কার

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “শেয়ারবাজারকে একটি শক্তিশালী ও বিশ্বাসযোগ্য বিনিয়োগমাধ্যমে রূপান্তরের জন্য তাৎক্ষণিক সংস্কার প্রয়োজন। সাধারণ মানুষ যেন বিনিয়োগ করে ঠকেন না, বরং দীর্ঘমেয়াদে লাভবান হন—সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, “শেয়ারবাজারে যে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং লুটপাটের চক্র দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় রয়েছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এই দুর্বৃত্তদের বিচার না হলে মানুষের আস্থা আর ফিরে আসবে না। পুঁজিবাজারের প্রতি দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা না গেলে জাতীয় অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”

তার মতে, এ বাজারকে একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থায় রূপান্তর করতে হবে। সুশাসন ও প্রযুক্তিনির্ভর পরিচালনা ব্যবস্থা ছাড়া তা সম্ভব নয়।

লুটেরাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান

ড. ইউনূস বলেন, “যারা কয়েক দশক ধরে লুটপাট করে শেয়ারবাজারকে নিঃস্ব করে দিয়েছেন, তারা অনেকেই প্রভাবশালী। কিন্তু এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হলে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। শেয়ারবাজার যেন কিছু সুবিধাভোগীর মুনাফার ক্ষেত্র হয়ে না দাঁড়ায়, সেজন্য সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও স্টেকহোল্ডারদের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।”

তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “শেয়ারবাজার একটি জাতীয় সম্পদ। এটি ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহৃত হলে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা না নিলে ভবিষ্যতেও শেয়ারবাজার সংকটে পড়বে।”

তিনি আরও যোগ করেন, “বিনিয়োগকারীরা দিনের পর দিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আন্দোলন করছেন। এটা অত্যন্ত লজ্জাজনক ও দুঃখজনক। আমরা এমন একটি পুঁজিবাজার চাই, যেখানে স্বচ্ছতা থাকবে, জবাবদিহি থাকবে এবং বিনিয়োগকারীরা নিরাপদে বিনিয়োগ করতে পারবেন।”

নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

বৈঠকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) ভূমিকা নিয়েও আলোচনা হয়। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিএসইসিকে আরও কার্যকর হতে হবে। শুধুমাত্র কাগজে-কলমে নিয়ন্ত্রণ নয়, বাস্তবিকভাবে বাজার পর্যবেক্ষণ, অনিয়ম শনাক্ত ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণে বিএসইসি আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।”

বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ বৈঠকে জানান, বাজার স্বাভাবিক রাখতে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ধরে রাখতে কমিশন নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তবে তিনি স্বীকার করেন যে, অনেক ক্ষেত্রে আইনি কাঠামো দুর্বল হওয়ায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়ে।

অর্থ উপদেষ্টার পরামর্শ

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য কাঠামোগত সংস্কার জরুরি। শেয়ারবাজার শুধু লেনদেনের জায়গা নয়, এটি দেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধির একটি প্রধান উৎস হতে পারে।”

তিনি আরও বলেন, “বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো, বাজারে তথ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন সঠিকভাবে যাচাইয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া, ম্যানিপুলেটিভ ট্রেডিং বন্ধে প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন।”

বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা

বিনিয়োগকারীরা বারবার অভিযোগ করছেন, বড় বিনিয়োগকারীরা কিংবা প্রভাবশালী চক্র একের পর এক কৃত্রিমভাবে বাজারে উত্থান-পতনের মাধ্যমে মুনাফা করে নিচ্ছে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা এতে বারবার ক্ষতির মুখে পড়ছেন।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) নিয়মিত আসা বিনিয়োগকারী মেহেদী হাসান বলেন, “বাজারে এখন এক ধরনের ভয় আর অনিশ্চয়তা কাজ করছে। কেউ জানে না আগামীকাল কী হবে। আমরা চাই সরকারের কার্যকর হস্তক্ষেপ এবং দোষীদের বিচার।”

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

প্রধান উপদেষ্টা বৈঠকে বলেন, “আমরা একটি কমিটি গঠন করব, যারা শেয়ারবাজার সংস্কারের বাস্তবধর্মী সুপারিশ নিয়ে কাজ করবে। এই কমিটিতে সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ের প্রতিনিধিরা থাকবেন।”

তিনি আশা প্রকাশ করেন, “এই ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে আগামী দিনে একটি স্থিতিশীল ও জনবান্ধব পুঁজিবাজার গড়ে তোলা সম্ভব হবে।”

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button