বিশ্ব

ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির পর আলোচনায় সিন্ধু পানিচুক্তি

দীর্ঘদিনের সংঘাতের পর ভারত ও পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ায় দুই দেশেই স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছে। সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ধীরে ধীরে জনজীবন স্বাভাবিক হচ্ছে, দোকানপাট খুলছে, মানুষ ঘরে ফিরছে। এই শান্ত পরিবেশে আবারো আলোচনায় এসেছে বহু পুরোনো এবং গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু—সিন্ধু পানিচুক্তি।

ভারতের সিদ্ধান্তে একতরফাভাবে স্থগিত হওয়া এই চুক্তি ঘিরে পাকিস্তানে তৈরি হয়েছে নতুন কূটনৈতিক উত্তেজনা। গত কয়েক দশকে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের জটিল আবর্তে পানিচুক্তি বরাবরই ছিল এক ধরনের স্থিতিশীলতার প্রতীক। কিন্তু চলতি বছর এপ্রিলের শেষদিকে ভারতের এই সিদ্ধান্তের পর পুরো বিষয়টি নতুন মোড় নিয়েছে।

হামলার জেরে চুক্তি স্থগিত

ঘটনার সূত্রপাত হয় গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামে এক রক্তক্ষয়ী হামলায়। ওইদিন পর্যটকদের ওপর চালানো বন্দুকধারীদের হামলায় নিহত হন অন্তত ২৬ জন। ভারত সরকার ওই হামলার জন্য পাকিস্তান-সমর্থিত জঙ্গিগোষ্ঠীকে দায়ী করে এবং তার প্রতিক্রিয়ায় নয়াদিল্লি সিন্ধু পানিচুক্তি সাময়িকভাবে স্থগিত করে।

এই সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে কূটনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। কারণ ১৯৬০ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের মধ্যে স্বাক্ষরিত সিন্ধু পানিচুক্তি এখন পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর এবং টিকে থাকা দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলোর একটি। এই চুক্তির আওতায় ভারত ও পাকিস্তান ছয়টি প্রধান নদীর জলবণ্টন নিয়ে একটি কাঠামোয় সম্মত হয়, যার মাধ্যমে তিনটি নদী (রবি, বিয়াস, এবং সুতলজ) ভারতের এবং তিনটি (সিন্ধু, ঝিলাম, চেনাব) পাকিস্তানের ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত হয়।

চুক্তির গুরুত্ব ও বর্তমান অবস্থা

সিন্ধু নদ শুধু পাকিস্তানের কৃষিখাতে নয়, দেশটির সামগ্রিক জীবিকা ও জ্বালানি উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দেশটির প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষিজমিতে এই নদী এবং এর উপনদীগুলোর মাধ্যমে সেচ দেওয়া হয়। ফলে ভারত থেকে পানি সরবরাহে সামান্য বিঘ্ন ঘটলেও এর প্রভাব হয় সুদূরপ্রসারী।

গত ৫ মে পাকিস্তানি দৈনিক ডন এক প্রতিবেদনে জানায়, ভারতের পক্ষ থেকে চেনাব নদীর পানি সাময়িকভাবে বন্ধ রাখায় নদীটির পাকিস্তান অংশে পানির প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। তবে এর একদিন পরেই ভারত আবারো পানি ছেড়ে দেয়। এরপর আজ পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশ সরকারের এক কর্মকর্তা ডনকে জানান, বর্তমানে সিন্ধু, চেনাব ও ঝিলাম নদীর পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রয়েছে।


আলোচনার সম্ভাবনা ও আন্তর্জাতিক চাপ

ভারতের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে চুক্তিটি পুনরায় কার্যকর করার বিষয়ে আলোচনায় বসতে চায় পাকিস্তান। গতকাল শনিবার যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকেই কূটনৈতিক মহলে আলোচনা জোরদার হয়েছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ রোববার জিও নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমরা ভারতের সঙ্গে সিন্ধু পানিচুক্তি, কাশ্মীর সংকট এবং নিরাপত্তা বিষয়ক আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। আমাদের লক্ষ্য একটি টেকসই সমাধান খুঁজে বের করা।” তবে আলোচনার নির্দিষ্ট তারিখ বা স্থান এখনো ঘোষণা করা হয়নি।

পাকিস্তানের সাবেক কর্মকর্তা এবং জলসম্পদ বিশেষজ্ঞ জাওয়াইদ লতিফ বলেন, “ভারত যেহেতু একতরফাভাবে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি স্থগিত করেছে, এটা শুধু দ্বিপক্ষীয় ইস্যু নয়। এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মঞ্চে কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো দরকার।” তিনি আরও বলেন, “যুদ্ধবিরতিতে মার্কিন প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সেই সূত্র ধরে পাকিস্তানের উচিত, ভারতকে চুক্তি কার্যকর করতে বাধ্য করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারস্থ হওয়া।”

সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া

সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে যুদ্ধবিরতির প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। আজ ভোরে শ্রীনগরের একটি বেকারির সামনে রুটি কেনার জন্য অপেক্ষমাণ শাকিলা জান বলেন, “যুদ্ধবিরতির খবরে আমি খুব খুশি। অনেকদিন পর আজ সকালে সন্তানদের নিয়ে শান্তিতে ঘর থেকে বের হতে পেরেছি।”

অন্যদিকে পাকিস্তানের জামশোরো শহরের বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, সিন্ধু নদে পানির স্তর কমে যাওয়ায় কিছু এলাকায় চরের সৃষ্টি হচ্ছে। ১৫ মার্চের একটি ছবিতে দেখা গেছে, নদীর বুকজুড়ে শুকনো মাটি। জলপ্রবাহে এই রকম ভাটার প্রভাব স্থানীয় কৃষকদের জীবনযাত্রাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।

দুই দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নির্ভর করছে পানি নীতির ওপর

বিশ্লেষকদের মতে, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নয়নের ক্ষেত্রে পানিচুক্তি একটি পরীক্ষার ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। চুক্তির প্রতি কোনো এক পক্ষের অনাস্থা বা একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণ দুই দেশের আস্থার সংকটকে আরও ঘনীভূত করতে পারে। একইসঙ্গে চুক্তিটি রক্ষা করা এবং কার্যকর রাখার মধ্য দিয়েই ভবিষ্যতে কাশ্মীর বা অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি সংকট সমাধানের পথ সুগম হতে পারে।

এমন এক সময়, যখন দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক সম্পদের সংকট তীব্র হয়ে উঠছে, তখন পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার মতো ইস্যুতে আন্তঃদেশীয় সহযোগিতা আরও জরুরি হয়ে পড়েছে। সিন্ধু পানিচুক্তিকে কেন্দ্র করে বর্তমান উত্তেজনা যে কেবল রাজনৈতিক নয়, তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে এর মানবিক ও পরিবেশগত প্রভাব বিশ্লেষণে।

উপসংহার

সিন্ধু পানিচুক্তি নিয়ে বর্তমান বিরোধ কেবল একটি চুক্তি রক্ষা করার প্রশ্ন নয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ায় স্থায়ী শান্তি, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং পরিবেশগত নিরাপত্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যুদ্ধবিরতির আবহে দুই দেশ যদি আন্তরিকতা ও বাস্তবতার ভিত্তিতে আলোচনায় বসে, তবে এই সংকট থেকে একটি ইতিবাচক ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা থেকেই যায়। এখন দেখার বিষয়, দুই দেশের নেতৃত্ব এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আগামী দিনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তি গড়ে তুলতে পারেন কি না।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button