বিশ্ব

গাজায় ত্রাণ প্রবেশে ইসরাইলি নিষেধাজ্ঞা: রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের উদ্বেগ

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের সামরিক অভিযান চলমান অবস্থায় মানবিক সংকট আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। খাদ্য, পানি ও ওষুধের তীব্র সংকটের মধ্যেই ত্রাণ প্রবেশে ইসরাইলি নিষেধাজ্ঞা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি গাজার বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘মানবিক বিপর্যয়’ এবং ‘বিশেষভাবে উদ্বেগজনক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

পুতিনের বক্তব্য: গাজায় মানবিক বিপর্যয় চলছে

রুশ বার্তা সংস্থা ও তুরস্কের আনাদোলু এজেন্সির বরাত দিয়ে জানা গেছে, শনিবার (১০ মে) মস্কোতে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে এক বৈঠকে পুতিন বলেন, “গাজা এখন সত্যিকারের মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। সেখানে নারী-শিশুদের খাবার, ওষুধ ও নিরাপদ আশ্রয়ের অভাব দেখা দিয়েছে।”

তিনি আরও জানান, “ইসরাইলের ত্রাণ প্রবেশে কঠোর নিষেধাজ্ঞা শুধু পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে, যা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। আমরা এই সংকটকে গভীর উদ্বেগ ও সহানুভূতির সঙ্গে দেখছি।”

রাশিয়ার সহায়তা ও অবস্থান

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, তাঁর দেশ ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং বন্ধুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। তিনি জানান, “গত এক বছরে রাশিয়া গাজার জন্য ৮০০ টনের বেশি খাদ্য, ওষুধ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করেছে।”

পুতিন দ্বি-রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানের পক্ষে রাশিয়ার অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, “এই অঞ্চলে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব কেবলমাত্র একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইনি কাঠামোর আওতায়, যা ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলি উভয় জনগণের জন্য পৃথক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন করে।”

আব্বাসের জবাব: গাজার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চায় ফিলিস্তিন

ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস পুতিনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “রাশিয়া বরাবরই ন্যায়বিচার, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠন এবং আমাদের অধিকার রক্ষার পক্ষে সোচ্চার থেকেছে।” তিনি আরও বলেন, “আমরা যুদ্ধবিরতির পক্ষে এবং গাজায় কোনো বিদেশি বা আমেরিকান প্রশাসনকে মেনে নিতে পারি না। গাজার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে ফিরিয়ে আনতে চাই।”

গাজায় মানবিক পরিস্থিতি চরমে

গত বছরের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরাইলে হামাসের হামলার পর ইসরাইল গাজায় পূর্ণমাত্রায় সামরিক অভিযান শুরু করে। হামাসের অভিযানে ১২০০ ইসরাইলি নিহত হন এবং প্রায় ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়।

ইসরাইলি প্রতিশোধ অভিযানে এক বছরের বেশি সময় ধরে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয় গাজা উপত্যকায়। ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় ৫২ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং ১ লাখ ১৮ হাজারের বেশি আহত হয়েছেন বলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা জানিয়েছে।

যুদ্ধবিরতি ও পুনরায় আগ্রাসন

প্রায় দেড় বছরের বেশি সময় চলা সংঘর্ষের পর আন্তর্জাতিক চাপে গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। তবে মার্চের মাঝামাঝি ফের আগ্রাসন শুরু করে ইসরাইল। দ্বিতীয় দফায় হামলায় আরও ২৭০০ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৭ হাজারের বেশি মানুষ আহত হন।

ত্রাণ প্রবেশে ইসরাইলি বাধা: আন্তর্জাতিক উদ্বেগ

বর্তমানে গাজার সবচেয়ে ভয়াবহ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ত্রাণ সরবরাহ। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বারবার ইসরাইলকে করিডোর খুলে দেওয়ার অনুরোধ জানালেও কার্যত তা অগ্রাহ্য করছে তেলআবিব।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থাগুলো বলছে, গাজার অন্তত ৮০ শতাংশ মানুষ এখন সরাসরি খাদ্য, পানি এবং চিকিৎসা সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। অথচ ইসরাইল একাধিক করিডোর বন্ধ রেখেছে এবং কেরেম শালোম ও রাফাহ ক্রসিং দিয়ে খুবই সীমিত ত্রাণ প্রবেশ করতে দিচ্ছে।

মানবিক সংগঠনগুলোর আশঙ্কা

আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফাম, রেড ক্রস, এবং ডব্লিউএইচও একাধিকবার সতর্ক করেছে যে, গাজা এখন দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে। গড়ে প্রতিদিন শত শত শিশু অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে ওষুধ নেই, বিদ্যুৎ নেই, এমনকি অপারেশন থিয়েটার চালানোর জেনারেটরের জন্যও জ্বালানি নেই।

ইসরাইলের প্রতিক্রিয়া

ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, তারা গাজার অভ্যন্তরে ‘হামাসের উপস্থিতি ও ত্রাণচোরাচালান’ ঠেকাতেই সীমান্ত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, ইসরাইল প্রকৃতপক্ষে গাজার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে মানবিক সহায়তাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।

পুতিনের হস্তক্ষেপ কতটা কার্যকর?

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এখন ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে একঘরে হয়ে পড়লেও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রভাব কম নয়। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের সরকারকে সমর্থন করে রাশিয়া যেমন একসময় আমেরিকান পরিকল্পনায় বাধা দিয়েছিল, তেমনি গাজা ইস্যুতেও তারা কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট ক্রমশ আরও জটিল হয়ে উঠছে। পুতিনের মতো বিশ্বনেতারা যখন গাজার মানবিক বিপর্যয় নিয়ে সরব হচ্ছেন, তখন আন্তর্জাতিক সমাজেরও উচিত বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা। খাদ্য ও ওষুধপ্রবাহ নিশ্চিত না হলে, এই সংকট কেবল মধ্যপ্রাচ্যের নয়, গোটা বিশ্বের বিবেকের জন্য লজ্জার কারণ হয়ে থাকবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button