সিগারেটের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব

বাংলাদেশে সিগারেট ও বিড়ির সহজলভ্যতা এবং স্বল্প মূল্যের কারণে তরুণদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তামাকজাত পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন দেশের তরুণ তাদের মতে, সিগারেট ও অন্যান্য তামাকপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি না করা গেলে ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব রোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে। এই প্রেক্ষাপটে, শনিবার (১০ মে) জাতীয় প্রেস ক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে প্ল্যাটফর্ম ডক্টরস ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তরুণ চিকিৎসকরা তামাক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন।
ধূমপানের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা: তরুণদের ঝুঁকি
বাংলাদেশে সিগারেটের সহজলভ্যতা এবং তুলনামূলক কম দাম তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতাকে উসকে দিচ্ছে। প্ল্যাটফর্ম ডক্টরস ফাউন্ডেশনের ফারজানা রহমান মুন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “সিগারেট যদি সস্তা থাকে, তবে তরুণেরা সহজেই এতে আসক্ত হয়ে পড়ে। এটি শুধু তাদের স্বাস্থ্যের জন্যই ক্ষতিকর নয়, বরং সমাজের সামগ্রিক ক্ষতির কারণ হচ্ছে।” তিনি জানান, প্রস্তাবিত কর কাঠামো সংস্কার এবং দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রায় ২৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপান ত্যাগে উৎসাহিত হতে পারেন। এছাড়া, এই পদক্ষেপ দীর্ঘমেয়াদে প্রায় ১৭ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু রোধ করতে পারে।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশে প্রতিবছর তামাকজনিত অসংক্রামক রোগে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছেন। এই মৃত্যুর হার কমাতে তামাকপণ্যের দাম বাড়িয়ে এটিকে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়া জরুরি।” তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, তামাকের ব্যবহার কমাতে সরকারকে কঠোর এবং কার্যকর নীতি গ্রহণ করতে হবে।
সিগারেটের মূল্যস্তর সংস্কারের প্রস্তাব
বর্তমানে বাংলাদেশে সিগারেটের চারটি মূল্যস্তর রয়েছে: নিম্ন, মধ্যম, উচ্চ এবং প্রিমিয়াম। তরুণ চিকিৎসকরা জানান, নিম্ন ও মধ্যম স্তরের দামের মধ্যে পার্থক্য খুবই কম, যার ফলে ধূমপায়ীরা সহজেই এক স্তর থেকে অন্য স্তরে চলে যেতে পারেন। এই সমস্যা সমাধানে তারা নিম্ন ও মধ্যম স্তর একত্র করে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের দাম কমপক্ষে ৯০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছেন। এছাড়া, উচ্চ স্তরের দাম ১৪০ টাকা অপরিবর্তিত রাখা এবং প্রিমিয়াম স্তরের দাম ১৯০ টাকা করার সুপারিশ করা হয়েছে।
এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে ধূমপানের হার কমার পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. শাফিউন নাহিন শিমুল জানান, “বর্তমানে তামাক থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা ব্যয়ের মাত্র ৭৫ শতাংশ পূরণ করতে পারে। কার্যকর কর নীতি প্রণয়ন করলে রাজস্ব আয় ৪৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব।” তিনি আরও বলেন, এই অতিরিক্ত রাজস্ব স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সম্ভব।
তামাকপণ্যের উপর প্রস্তাবিত কর ও শুল্ক
চিকিৎসকদের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, সিগারেটের খুচরা মূল্যের ওপর ৬৭ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক, ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বহাল রাখার দাবি জানানো হয়েছে। এই কর কাঠামো ধূমপান নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে সহায়ক হবে।
এছাড়া, তামাকের অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও দাম ও শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- ফিল্টারবিহীন বিড়ি: ২৫ শলাকার দাম ২৫ টাকা এবং ৪৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক।
- ফিল্টারযুক্ত বিড়ি: ২০ শলাকার দাম ২০ টাকা এবং ৪৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক।
- জর্দা: প্রতি ১০ গ্রামের দাম ৫৫ টাকা এবং ৬০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক।
- গুল: প্রতি ১০ গ্রামের দাম ৩০ টাকা এবং ৬০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক।
এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়িত হলে তামাকপণ্যের ব্যবহার হ্রাস পাবে এবং বিশেষ করে তরুণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী ধূমপানে নিরুৎসাহিত হবে।
তামাক নিয়ন্ত্রণে বৃহত্তর লক্ষ্য
বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের ফলে প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত ক্ষতি হচ্ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাকজনিত চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হ্রাসের কারণে ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল। এই ক্ষতি কমাতে তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি সচেতনতামূলক প্রচারণা এবং কঠোর নীতি প্রণয়নের প্রয়োজন।
অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স (আত্মা) এর সাম্প্রতিক প্রস্তাবে বলা হয়, সিগারেটের মূল্যস্তর চারটি থেকে তিনটিতে নামিয়ে আনলে তামাক নিয়ন্ত্রণ আরও কার্যকর হবে। এই সংস্কারের ফলে ধূমপান হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় ২০ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি পেতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিতি
সংবাদ সম্মেলনে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরামর্শক মো. নাইমুল আজম খান, সমন্বয়ক ডা. অরুনা সরকার, প্রজ্ঞার হেড অব প্রোগ্রামস মো. হাসান শাহরিয়ার এবং বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি মো. রাশেদ রাব্বি উপস্থিত ছিলেন। তারা সকলেই তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের ওপর জোর দেন।
উপসংহার
তামাক ব্যবহার বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি। তরুণ চিকিৎসকদের প্রস্তাবিত দাম বৃদ্ধি এবং কর কাঠামো সংস্কার তামাক নিয়ন্ত্রণে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে ধূমপানের হার কমার পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সম্ভব হবে। সরকার, নীতিনির্ধারক এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব।