পাকিস্তানের ‘বুনইয়ানুম মারসুস’ অভিযানের অর্থ কী

‘বুনইয়ানুম মারসুস’: একটি নাম, একটি বার্তা
ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক পাল্টা হামলার অংশ হিসেবে পাকিস্তান তাদের সামরিক অভিযানের নাম দিয়েছে ‘বুনইয়ানুম মারসুস’। পাকিস্তানের সামরিক জনসংযোগ বিভাগ আইএসপিআর জানায়, এ নামটি কেবল একটি অপারেশনাল টাইটেল নয়—এটি একটি গভীর ধর্মীয়, আদর্শিক এবং মনস্তাত্ত্বিক বার্তা বহন করে।
এই নামটি নেওয়া হয়েছে পবিত্র কোরআনের সূরা আল-সাফ-এর ৪ নম্বর আয়াত থেকে। আরবি শব্দগুচ্ছ “بنيان مرصوص” বা “বুনইয়ানুম মারসুস” অনুবাদ করলে দাঁড়ায়:
“সীসা দিয়ে গাঁথা এক অটুট দেয়াল”।
এই রূপকটি ইসলামী দর্শনে ঐক্য, দৃঢ়তা, ও অপ্রতিরোধ্য প্রতিরক্ষা-র প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
সূরা আল-সাফ ৬১:৪ — আয়াতের অর্থ
সূরা আল-সাফ, আয়াত ৪:
“নিশ্চয়ই আল্লাহ ভালোবাসেন তাদের, যারা তাঁর পথে সংগ্রাম করে একটি সীসা গাঁথা প্রাচীরের মতো কাতারবদ্ধ হয়ে।”
(সূরা আস-সাফ, আয়াত ৪)
এই আয়াতে মূলত আল্লাহর পথে সংগঠিতভাবে, সংহতভাবে এবং অটলভাবে যুদ্ধ করার প্রশংসা করা হয়েছে। ইসলামি ঐতিহ্যে এই আয়াতটি বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে একতা ও সাহসিকতার উদাহরণ হিসেবে।
আইএসপিআর-এর বক্তব্য: একটি প্রতীকী বার্তা
পাকিস্তানের আইএসপিআর (Inter-Services Public Relations) জানিয়েছে, ‘বুনইয়ানুম মারসুস’ নামটি কেবল ধর্মীয় রেফারেন্স নয়, এটি তাদের বাহিনীর “ঐক্য, প্রতিরোধ, এবং প্রস্তুতির প্রতীক”।
আইএসপিআরের ভাষায়:
“আমাদের সেনাবাহিনী একটি সীসা গাঁথা প্রাচীরের মতো সংগঠিত ও অটুট। এই অভিযানের নাম সেই ঐতিহ্য, আদর্শ ও মানসিক দৃঢ়তার প্রতিনিধিত্ব করে।”
অভিযানের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট
২০২৫ সালের মে মাসে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা নতুন করে তীব্র রূপ নিয়েছে। একাধিক হামলা, পাল্টা হামলা এবং সামরিক চাপানউতোরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দুই পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র। এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান সামরিকভাবে ‘কাউন্টার অ্যাটাক’ শুরু করে এবং সেটিকে ‘বুনইয়ানুম মারসুস’ নামে ঘোষণা করে।
এই নামকরণ শুধু সামরিক কৌশলের প্রকাশ নয়—বরং এটি ধর্মীয় আবেগ, আত্মবিশ্বাস এবং জাতীয় ঐক্যের বার্তাও বহন করে।
ধর্মীয় রেফারেন্সে সামরিক নামকরণ: অতীতেও দৃষ্টান্ত আছে
‘বুনইয়ানুম মারসুস’ নামকরণ পাকিস্তানে একেবারে নতুন কিছু নয়। অতীতেও পাকিস্তান ও অন্যান্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো কোরআন ও ইসলামি ইতিহাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সামরিক অভিযান বা অপারেশনের নামকরণ করেছে। যেমন:
- “গজনভি” অপারেশন – ইতিহাসের বিখ্যাত মুসলিম বিজয়ীর নামে
- “জারব-ই-আজব” – অর্থাৎ “শক্তিশালী আঘাত”, ২০১৪ সালের উত্তর ওয়াজিরিস্তানে তালেবানবিরোধী অভিযানের নাম
এইসব নাম সাধারণত ধর্মীয় অনুপ্রেরণা, মানসিক উজ্জীবন এবং রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছে দিতে ব্যবহৃত হয়।
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ
যখন কোনো দেশ কোরআন থেকে সামরিক অভিযানের নাম নেয়, তখন এর ভেতরে ধর্মীয় প্রভাব তো থাকেই, পাশাপাশি এতে থাকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিরও প্রতিক্রিয়া। ভারতের মতো বহুধর্মীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এমন একটি ধর্মীয়-রেফারেন্সযুক্ত সামরিক অভিযানের নামকরণ স্নায়ুযুদ্ধের কৌশলের অংশ হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
এতে পাকিস্তান তার জনগণের মনোবল দৃঢ় করতে চায়, এবং একইসঙ্গে মুসলিম বিশ্বকে একরকম বার্তা দিতে চায় যে তারা “আধ্যাত্মিক ন্যায্যতার ভিত্তিতে লড়ছে”।
সামরিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক
একটি সামরিক অভিযানের নাম যখন ধর্মীয় ঐতিহ্য থেকে আসে, তখন তা সৈনিকদের মানসিক দৃঢ়তা, আত্মবিশ্বাস এবং “ন্যায়সঙ্গত লড়াইয়ের” বোধ জাগিয়ে তোলে। ‘বুনইয়ানুম মারসুস’ নামটি পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে সংগঠন, একতা ও আত্মত্যাগের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।
‘বুনইয়ানুম মারসুস’ কেবল একটি সামরিক অভিযানের নাম নয়—এটি একটি শক্ত প্রতীক, যা ঐক্য, প্রতিরোধ এবং আধ্যাত্মিক ন্যায্যতার বার্তা বহন করে। পাকিস্তান এই নামের মাধ্যমে শুধু ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিচ্ছে না, বরং অভ্যন্তরীণভাবে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানাচ্ছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে একটি শক্ত বার্তা দিচ্ছে।
এই নামকরণ আরও একবার প্রমাণ করে, ধর্ম, সামরিক কৌশল ও রাজনীতি—এই তিনটি উপাদান কতটা ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে থাকে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায়।