সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগ: তদন্ত কমিটির রিপোর্ট তিনদিনের মধ্যে

সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের হঠাৎ দেশত্যাগের ঘটনা ঘিরে রাজনৈতিক মহল এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা প্রশ্ন ও জল্পনা-কল্পনা তৈরি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, যাদের তিনদিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
শনিবার (১০ মে) দুপুরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কার্যক্রম পরিদর্শনে গিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এই কথা জানান। তিনি বলেন, “সাবেক রাষ্ট্রপতি কীভাবে দেশ ছেড়েছেন, সেটা এখন তদন্তাধীন। তিন দিনের মধ্যে তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দেবে। এরপর জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তদন্তের ফোকাস: নিষেধাজ্ঞা ছিল কি না?
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও জানান, সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশত্যাগের আগে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) থেকে কোনও ধরনের নিষেধাজ্ঞা বা সতর্কতা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল কি না, সেই বিষয়টিও তদন্তাধীন রয়েছে। তবে এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।
বিশ্লেষকদের মতে, দেশের একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধানের হঠাৎভাবে দেশত্যাগ করা এবং তা নিয়ে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট মহলের অস্পষ্টতা, সরকারি তথ্যপ্রবাহে বড় ধরনের ফাঁক নির্দেশ করে। সাধারণত উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের বিদেশ যাত্রার সময় একটি প্রটোকল ও নিরাপত্তা-সংক্রান্ত ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় স্পেশাল ব্রাঞ্চ, ইমিগ্রেশন বিভাগ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অস্বাভাবিক।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার প্রসঙ্গেও মন্তব্য
একই সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনার বিষয়েও ইঙ্গিত দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি জানান, “ইন্টারপোল কাজ করছে।” তবে এ বিষয়ে তিনি বিস্তারিত কিছু বলেননি।
এই মন্তব্য থেকে ধারণা করা যাচ্ছে যে, শেখ হাসিনার অবস্থান বা সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তন নিয়ে সরকার কোনোভাবে সক্রিয়, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গ্রহণের চেষ্টা চলছে।
আন্দোলন নিয়ে সরকারের অবস্থান
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে চলমান আন্দোলনের প্রসঙ্গেও মন্তব্য করেছেন জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, “আন্দোলনের কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। আন্দোলন এমন স্থানে হওয়া উচিত, যাতে জনদুর্ভোগ না হয়।”
এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, সরকার রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি একেবারে বিরূপ নয়, তবে জনজীবনে তার প্রভাব কম রাখতে চায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারবিরোধী কর্মসূচি এবং অবরোধ চলমান রয়েছে, যেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রশাসনের দায়িত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।
কেন এই ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ?
সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসে একমাত্র ব্যক্তি যিনি দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন (২০১৩–২০২৩)। তাঁর দেশত্যাগ যদি সত্যিই প্রশাসনের অজ্ঞাতসারে হয়ে থাকে, তাহলে এটি প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের ব্যর্থতা হিসেবেই ধরা হবে।
তথ্যপ্রবাহ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় যদি এমন উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তির বিষয়ে স্বচ্ছতা না থাকে, তাহলে সাধারণ নাগরিক কিংবা নিরাপত্তা-হুমকি বিবেচনায় থাকা ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণ কতটা কার্যকর—সেই প্রশ্নও উঠছে।
বিশেষ করে, যদি তার বিরুদ্ধে কোনো নিষেধাজ্ঞা বা তদন্ত চলমান থাকতো এবং তারপরও তিনি দেশত্যাগ করে থাকেন, তবে তা প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতির প্রমাণ হতে পারে।
রাজনীতিতে এর প্রভাব
সাবেক রাষ্ট্রপতির হঠাৎ দেশত্যাগ, বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে এই ঘটনার উদ্ভব একটি বড় রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হতে পারে। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, সরকার এই পরিস্থিতি থেকে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে তদন্তের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
অন্যদিকে, বিরোধী রাজনৈতিক মহল এই ঘটনাকে প্রশাসনিক ব্যর্থতার উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার কৌশল নিতে পারে। ফলে তদন্ত প্রতিবেদন ও পরবর্তী পদক্ষেপ রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র আলোচনার জন্ম দিতে পারে।
সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনে নতুন একটি প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করেছে। সরকার যেভাবে দ্রুত তদন্ত কমিটি গঠন করে তিনদিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে, তা ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখা যাচ্ছে। তবে এই তদন্ত কতটা স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হবে, এবং এর ভিত্তিতে কোন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেটাই এখন মূল প্রশ্ন।
সরকার যদি এই তদন্তে যথাযথ স্বচ্ছতা বজায় রাখতে পারে এবং প্রয়োজনে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তাহলে প্রশাসনের ওপর মানুষের আস্থা কিছুটা হলেও পুনঃপ্রতিষ্ঠা পাবে।