অর্থনীতি

ব্যাংক পরিচালকদের বেনামি ঋণও এখন হিসাবের আওতায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে আবারও কড়া পদক্ষেপ নিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের পরিচালক ও তাঁদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঋণ গ্রহণে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে নতুন নীতিমালা জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন এই নির্দেশনার ফলে ব্যাংক পরিচালকদের বেনামি ও সুবিধাভোগী ঋণ হিসাবের আওতায় আসবে, যা দীর্ঘদিন ধরেই নজরদারির বাইরে থেকে আসছিল।

গত বৃহস্পতিবার (৮ মে) বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে বলা হয়, কোনো ব্যাংকের পরিচালক সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে তাদের পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশের বেশি ঋণ নিতে পারবেন না। পাশাপাশি এক কোটি টাকার বেশি ঋণ নিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বানুমতি নিতে হবে।

বেনামি ও সুবিধাভোগী ঋণও আসবে হিসাবের আওতায়

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পরিচালকদের নামে না থাকা ঋণ—অর্থাৎ বেনামি ও প্রকৃত সুবিধাভোগী (beneficial owner) ঋণ—এখন থেকে হিসাবের মধ্যে গণ্য হবে। আগে অনেক পরিচালক তাঁদের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি বা বিভিন্ন কাগুজে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতেন, যা আইনত পরিচালক ঋণ হিসেবে ধরা হতো না। নতুন নীতিমালায় এমন সব ঋণকেও আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচালকদের ঋণের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আশা, এতে করে বেনামি ঋণপ্রাপ্তির প্রবণতা কমবে এবং ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা আসবে।

টিয়ার–১ মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি ঋণ নয়

কোনো ব্যাংক তাদের টিয়ার–১ মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি ঋণ কোনো একক বা সম্মিলিতভাবে ব্যাংক–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দিতে পারবে না। যদি কোনোভাবে এই সীমা অতিক্রম করা হয়, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে অবহিত করতে হবে এবং একটি সংশোধনমূলক কর্মপরিকল্পনাও দাখিল করতে হবে।

ঋণ সীমা লঙ্ঘনের শাস্তি

নতুন নীতিমালায় স্পষ্ট বলা হয়েছে—যদি কোনো ঋণ অনুমোদিত সীমা অতিক্রম করে, তাহলে তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হবে এবং নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে ওই অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করতে হবে। একইসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া এমন ঋণ নবায়ন বা পরির্বতন করা যাবে না।

ব্যাংক পরিচালকদের জন্য পূর্বানুমতির বাধ্যবাধকতা

ব্যাংকের কোনো পরিচালক যদি ৫০ লাখ টাকার বেশি প্রত্যক্ষ ঋণ অথবা এক কোটি টাকার বেশি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ঋণ নিতে চান, তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমতি নিতে হবে। শুধু তাই নয়, এই অনুমতি নেওয়ার জন্য আবেদনের সঙ্গে সিআইবি (Credit Information Bureau) রিপোর্ট, পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন এবং ‘ন্যায্য আচরণের’ প্রমাণ দাখিল করতে হবে। আবেদনটি অবশ্যই বিদ্যমান ঋণ সুবিধার মেয়াদ শেষ হওয়ার অন্তত সাত কার্যদিবস আগে জমা দিতে হবে।

সিইও ও এমডিদের ক্ষেত্রেও কঠোরতা

ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)-দের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ব্যাংক আলাদা ও কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এদের বা তাঁদের নিয়ন্ত্রণাধীন বা সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানকে কোনোভাবেই জামানতবিহীন ঋণ বা অগ্রিম দেওয়া যাবে না।

এমডি ও সিইও যেহেতু চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তা, তাই তাঁদের ‘কর্মচারী ঋণ প্রকল্প’ থেকেও বাইরে রাখা হয়েছে। তবে তাঁদের জন্য সাধারণ গ্রাহকের শর্তে ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করা যেতে পারে—তবে এই কার্ড ইস্যুর অন্তত সাত কার্যদিবস আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে হবে।

আয় মওকুফেও অনুমতির শর্ত

নতুন নির্দেশনায় বলা হয়েছে, এমডি–সিইও বা তাঁদের ঘনিষ্ঠদের কোনো সুদ, মুনাফা বা আসল অর্থ মওকুফ করার জন্যও বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমতি নিতে হবে। অর্থাৎ, এসব ঋণের ওপর কোনো অর্থ ছাড় দেওয়ার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

ঋণ হিসাব জমা দিতে হবে প্রতি মাসে

পরিচালকদের সংশ্লিষ্ট প্রত্যক্ষ বা সুবিধাভোগী ঋণের হিসাব আগামী সেপ্টেম্বর ২০২৫ থেকে প্রতি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিতে হবে। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়মিতভাবে পরিচালকদের ঋণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে পারবে এবং অনিয়ম চিহ্নিত করে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারবে।

কেন এই পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ?

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে পরিচালকদের প্রভাব অনেক বেশি। অতীতে বহুবার দেখা গেছে, পরিচালকরা নিজেদের প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে অতিরিক্ত ঋণ নিয়েছেন, যা পরে খেলাপি হয়ে ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্যকে বিপর্যস্ত করেছে। অনেক সময় এসব ঋণ বেনামি হিসেবে অন্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নেওয়া হয়, যা আইনগত ফাঁকফোকর ব্যবহার করে পরিচালকদের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে সাহায্য করেছে।

এই বাস্তবতা থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, যাতে পরিচালকদের ঋণ সীমার মধ্যে রাখা যায় এবং ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নতুন নির্দেশনা ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে একটি বড় পদক্ষেপ। পরিচালকদের বেনামি ঋণও যখন হিসাবের আওতায় আসবে, তখন ঋণ গ্রহণের প্রবণতা কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে পরিচালক ও ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের স্বেচ্ছাচারিতা রোধ হবে এবং সাধারণ আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা পাবে। নতুন এই নীতিমালা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে তা ব্যাংকিং খাতকে স্থিতিশীল ও টেকসই করে তুলতে সহায়ক হবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button