নিজ দেশের সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ওয়্যার’ বন্ধ করলো ভারত সরকার

ভারত সরকারের সাম্প্রতিক এক পদক্ষেপে দেশটির জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ওয়্যার’-এর ওয়েবসাইট ব্লক করা হয়েছে, যা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। শুক্রবার (৯ মে, ২০২৫) ‘দ্য ওয়্যার’ কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ভারত সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি আইন, ২০০০-এর অধীনে ইলেকট্রনিক্স ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলো তাদের ওয়েবসাইটে প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দিয়েছে। এই ঘটনাকে ‘দ্য ওয়্যার’ ‘প্রকাশ্য সেন্সরশিপ’ হিসেবে অভিহিত করেছে, যা ভারতের সংবিধানে নিশ্চিত সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে তারা দাবি করেছে।
‘দ্য ওয়্যার’-এর বিবৃতি অনুসারে, ভারতজুড়ে তাদের পাঠকরা ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন, এবং ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলো জানিয়েছে যে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের আদেশে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপের কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ বা আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়নি, যা এই সিদ্ধান্তকে আরও বিতর্কিত করে তুলেছে। ‘দ্য ওয়্যার’ এই ঘটনাকে ভারতের গণতান্ত্রিক চেতনার উপর সরাসরি আঘাত হিসেবে বর্ণনা করেছে এবং এর বিরুদ্ধে আইনি ও নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোতে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘দ্য ওয়্যার’ তাদের বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে, “ভারতের মতো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য বস্তুনিষ্ঠ, সত্যনিষ্ঠ, এবং সুষ্ঠু সংবাদ ও তথ্য সবচেয়ে বড় সম্পদ।” তারা আরও জানিয়েছে, এমন একটি সংকটময় সময়ে, যখন ভারতের জনগণের সত্য জানার অধিকার অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, সরকারের এই পদক্ষেপ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। সংবাদমাধ্যমটি এই সেন্সরশিপকে ‘অযৌক্তিক ও স্বেচ্ছাচারী’ বলে সমালোচনা করেছে এবং এর বিরুদ্ধে সকল প্রকার আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে।
‘দ্য ওয়্যার’ গত দশ বছর ধরে ভারতের সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তাদের সাহসী এবং সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জন্য তারা দেশ-বিদেশে প্রশংসিত। এই সংবাদমাধ্যমটি তাদের পাঠকদের সমর্থনের উপর নির্ভর করে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এবং এই সংকটের সময়েও তারা তাদের পাঠকদের প্রতি আশাবাদী। বিবৃতিতে তারা বলেছে, “গত ১০ বছর ধরে আপনাদের সমর্থনই আমাদের সাহস দিয়েছে। এবারও আমরা একসাথে দাঁড়াবো। আমরা সত্য এবং সঠিক সংবাদের প্রকাশ থেকে কখনও পিছিয়ে আসবো না।”
এই ঘটনা ভারতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর ক্রমবর্ধমান হুমকির একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ। বিগত কয়েক বছরে ভারত সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ, যেমন সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ব্লক করা, সাংবাদিকদের উপর চাপ সৃষ্টি করা, এবং স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বৃহস্পতিবার (৮ মে, ২০২৫) এক্স (পূর্বে টুইটার) জানিয়েছে, ভারত সরকার তাদের প্ল্যাটফর্মে প্রায় ৮,০০০ অ্যাকাউন্ট ব্লক করার নির্দেশ দিয়েছে, যার মধ্যে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম, অ্যাক্টিভিস্ট, এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের অ্যাকাউন্টও রয়েছে। এই ঘটনাগুলো ভারতের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণের একটি ধারাবাহিক চিত্র তুলে ধরে।
ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি আইন, ২০০০-এর ৬৯(ক) ধারার অধীনে সরকারের কাছে বিষয়বস্তু অপসারণ বা ব্লক করার ক্ষমতা রয়েছে, যা প্রায়শই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এই ধারার অপব্যবহারের অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে উঠছে, বিশেষ করে যখন এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে ব্যবহৃত হয়। ‘দ্য ওয়্যার’-এর ক্ষেত্রে এই ধারার অধীনে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই ওয়েবসাইট ব্লক করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, যা এই আইনের স্বচ্ছতা এবং ন্যায্যতার প্রশ্ন তুলেছে।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ভারতের গণতান্ত্রিক সমাজে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকে এই পদক্ষেপকে ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোর উপর একটি ‘অশনি সংকেত’ হিসেবে দেখছেন। ‘দ্য ওয়্যার’ তাদের বিবৃতিতে ‘সত্যমেব জয়তে’ উদ্ধৃত করে সত্যের পথে অবিচল থাকার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। তারা জানিয়েছে, “সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী।” এই ঘোষণা তাদের সাংবাদিকতার প্রতি অঙ্গীকার এবং সরকারি চাপের মুখেও পিছু না হটার দৃঢ়তা প্রকাশ করে।
এই ঘটনার আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াও উল্লেখযোগ্য। ভারতের সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর ক্রমবর্ধমান হুমকি নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং মানবাধিকার গোষ্ঠী উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের বিশেষ দূতবৃন্দ এর আগে ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সমালোচনা করে বলেছেন, এই আইন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ‘দ্য ওয়্যার’-এর বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক পদক্ষেপ এই সমালোচনাকে আরও জোরালো করেছে।
ভারতের অভ্যন্তরে এই ঘটনা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ডিজিপাব, একটি ডিজিটাল মিডিয়া সংগঠন, ‘দ্য ওয়্যার’-এর ওয়েবসাইট ব্লক করার নিন্দা জানিয়েছে। এছাড়া, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) নেতা ডি. রাজা তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের কাছে এই ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদপত্র লিখেছেন। এই প্রতিক্রিয়াগুলো ভারতের গণতান্ত্রিক সমাজে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি সমর্থনের ইঙ্গিত দেয়।
‘দ্য ওয়্যার’-এর এই সংকট ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। সরকারের এই পদক্ষেপ কেবল একটি সংবাদমাধ্যমকে লক্ষ্য করে নয়, বরং এটি ভারতের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং সত্য প্রকাশের অধিকারের উপর একটি বৃহত্তর আঘাত। ‘দ্য ওয়্যার’-এর সংগ্রাম এখন কেবল তাদের নিজস্ব নয়, বরং এটি ভারতের সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য একটি বৃহত্তর লড়াইয়ের প্রতীক।