বিশ্ব

ভারতের হামলায় ইসরায়েলি ড্রোন ব্যবহার: পাকিস্তানের দাবি, ভূপাতিত ২৫টি হরপ ড্রোন

পাকিস্তান-ভারত সীমান্ত উত্তেজনা নতুন মাত্রা পেয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, ভারত পাকিস্তানে হামলার জন্য ইসরায়েলের তৈরি ‘হরপ’ (Harop) কামিকাজে ড্রোন ব্যবহার করেছে। পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ বিভাগ (ISPR) এক বিবৃতিতে জানায়, তারা বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত মোট ২৫টি ইসরায়েলি হরপ ড্রোন ভূপাতিত করেছে।

এই দাবি পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে চলমান সামরিক উত্তেজনাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নতুন আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে, বিশেষ করে যখন এতে ইসরায়েলের প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়টি উঠে এসেছে।

হরপ ড্রোন কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ?

হরপ (Harop) ড্রোনটি ইসরায়েলের রাষ্ট্রায়ত্ত ডিফেন্স প্রতিষ্ঠান IAI (Israel Aerospace Industries)-এর তৈরি। এটি মূলত একটি ‘লোইটারিং মিউনিশন’ বা কামিকাজে ড্রোন, যা লক্ষ্যস্থির করে অনেকক্ষণ আকাশে চক্কর দিতে পারে এবং নিজেই বিস্ফোরিত হয়ে আঘাত হানে। অর্থাৎ, এটি লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করার পর নিজেই তা ধ্বংস করতে ব্যবহৃত হয়।

ড্রোনটির গতি ঘণ্টায় প্রায় ১৮৫ কিলোমিটার এবং এটি প্রায় ৬ ঘণ্টা আকাশে বিচরণ করতে পারে। এতে ১৫ কেজি বিস্ফোরক বসানো থাকে। হরপ ড্রোন প্রথম ব্যবহৃত হয় আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার যুদ্ধে। পরবর্তীতে ইসরায়েল এটি ভারতের কাছে সরবরাহ করে।

পাকিস্তানের দাবি: ভারত হরপ ড্রোন দিয়ে হামলা চালিয়েছে

আইএসপিআর জানায়, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সফট-কিল ও হার্ড-কিল প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভারতের পাঠানো সবগুলো হরপ ড্রোন ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়েছে। সফট-কিল প্রযুক্তি মানে ড্রোনের কমিউনিকেশন সিগন্যাল জ্যাম করে তা নিস্ক্রিয় করা এবং হার্ড-কিল মানে সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র বা গোলা ব্যবহার করে ধ্বংস করা।

পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়েছে, “এই ড্রোনগুলো মূলত ভারতের সাম্প্রতিক বিমান হামলার ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার জন্য পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু আমরা প্রতিটি ড্রোন সাফল্যের সাথে ভূপাতিত করেছি।”

কাশ্মীর সীমান্তে বড় ক্ষয়ক্ষতির দাবি

কাশ্মীর সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ রেখায় ভারতীয় সেনাবাহিনী বড় ধরণের ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে বলেও দাবি করেছে পাকিস্তান। এক বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা শুধু ড্রোনই ভূপাতিত করিনি, বরং পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ভারতের পাঁচটি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান এবং একাধিক ড্রোন ধ্বংস করেছি। এতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।”

যদিও ভারতের তরফ থেকে এখনো এই বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।

ড্রোন ধ্বংসের ভিডিও ও ধ্বংসাবশেষ জড়ো করা হচ্ছে

পাকিস্তানের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, বিভিন্ন জেলায় ড্রোনগুলোর ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেছে এবং সেগুলো এখন নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে রয়েছে। এই ধ্বংসাবশেষ বিশ্লেষণ করে আরও তথ্য বের করার চেষ্টা চলছে।

সামাজিক মাধ্যমে ইতোমধ্যেই ড্রোন ধ্বংসের কিছু ভিডিও এবং ছবি ছড়িয়ে পড়েছে বলে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম দাবি করেছে। তবে এসব তথ্যের সত্যতা স্বাধীনভাবে যাচাই করা যায়নি।

ভারতের হামলার জবাবে পাল্টা প্রতিক্রিয়া

৬ মে ভারতে অভিযুক্ত বিমান হামলার জবাবে পাকিস্তানের এই প্রতিক্রিয়া ঘটেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। ওই হামলায় পাকিস্তানে অন্তত ৩১ জন নিহত হন বলে দেশটির সরকার দাবি করেছে। এর মধ্যে বেসামরিক লোকও রয়েছেন।

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, “শত্রুর প্রতিটি অশুভ পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিতে আমরা সক্ষম। পাকিস্তানের আকাশসীমা রক্ষায় আমরা সর্বোচ্চ প্রস্তুত।”

ইসরায়েলের প্রযুক্তি ব্যবহারে নতুন আন্তর্জাতিক সংকেত

এই ঘটনাটি একে বিশ্ব রাজনীতির আরও জটিল ছকেও নিয়ে যাচ্ছে। কারণ ভারত ইসরায়েল থেকে বহু বছর ধরে সামরিক প্রযুক্তি আমদানি করছে। হরপ ড্রোন ছাড়াও ভারত IAI-এর হেরন (Heron) ড্রোন, ব্যারাক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা এবং ফ্যালকন রাডারসহ বহু সামরিক সরঞ্জাম কিনেছে। তবে এই প্রথম পাকিস্তান সরকার সরাসরি অভিযোগ করল যে, ভারত পাকিস্তানে হামলার জন্য ইসরায়েলের আক্রমণাত্মক ড্রোন ব্যবহার করছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একাধিক প্রশ্ন তুলবে—বিশেষ করে ইসরায়েলের অস্ত্র ব্যবহারের নৈতিকতা ও ভারতের আঞ্চলিক কৌশল নিয়ে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে পাকিস্তান-ভারত দুই দেশের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র থাকার কারণে যেকোনো সামরিক সংঘর্ষ বড় আকার নিতে পারে। জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই উভয় পক্ষকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে।

চীন ও তুরস্কের পক্ষ থেকেও পাকিস্তানের আকাশসীমা লঙ্ঘনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। তবে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এখনো কোনো মন্তব্য আসেনি।

বিশেষজ্ঞদের মতামত: এই পরিস্থিতি কতটা ঝুঁকিপূর্ণ?

সামরিক বিশ্লেষক মেজর (অব.) ইফতেখার রহমান বলেন, “হরপ ড্রোন একটি অত্যন্ত শক্তিশালী অস্ত্র। এটি কোনো নিয়মিত নজরদারি ড্রোন নয়, বরং নিজেই বিস্ফোরিত হয়ে আক্রমণ চালায়। এই ধরনের ড্রোন ব্যবহার কোনো দেশের ওপর সরাসরি আক্রমণের শামিল।”

তিনি আরও বলেন, “এটি শুধু ভারত-পাকিস্তান নয়, দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।”

সারসংক্ষেপে মূল তথ্য

  • পাকিস্তানের দাবি: ভারত হামলায় ইসরায়েলি ‘হরপ’ ড্রোন ব্যবহার করেছে
  • ভূপাতিত ড্রোন: ২৫টি
  • ধ্বংস: ভারতীয় ৫টি যুদ্ধবিমান, একাধিক ড্রোন
  • নিহত: ভারতের হামলায় পাকিস্তানে ৩১ জন
  • পাল্টা প্রতিক্রিয়া: পাকিস্তান সীমান্তে ব্যাপক জবাব দিয়েছে
  • আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের সংযমের আহ্বান
  • ইসরায়েলের প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্বেগ
মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button