বিশ্ব

প্রতিটি রক্তবিন্দুর প্রতিশোধ নেয়া হবে: শাহবাজ শরিফ

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ভারতের সাম্প্রতিক বিমান হামলায় নিহতদের প্রতিটি রক্তবিন্দুর প্রতিশোধ নেওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেছেন। বুধবার (৭ মে) রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক আবেগপ্রবণ ভাষণে তিনি ভারতের এই হামলাকে ‘কাপুরুষোচিত’ ও ‘অগ্রহণযোগ্য’ আখ্যায়িত করে তীব্র নিন্দা জানান এবং পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কঠোর প্রতিক্রিয়ার হুঁশিয়ারি দেন। বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ৩০ মিনিটে টেলিভিশনে প্রচারিত এই ভাষণে তিনি পাকিস্তানি জনগণের ঐক্য ও সশস্ত্র বাহিনীর সাহসিকতার প্রশংসা করেন।

ভারতের হামলা ও পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া

শাহবাজ শরিফ তার ভাষণে বলেন, “ভারত পাকিস্তানের ভূখণ্ডে হামলা করে একটি অতি গুরুতর ভুল করেছে। তারা ভেবেছিল, পাকিস্তান এই আগ্রাসনের মুখে পিছিয়ে যাবে। কিন্তু তারা ভুলে গেছে, এটি এমন একটি জাতি, যারা তাদের মাতৃভূমির জন্য জীবন দিতে জানে।” তিনি জোর দিয়ে বলেন, ভারতকে এই হামলার জন্য অবশ্যই মূল্য দিতে হবে।

৬ মে মধ্যরাতে ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে একটি সামরিক অভিযানের আওতায় পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের নয়টি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ভারতের দাবি, এই হামলার লক্ষ্য ছিল ‘সন্ত্রাসী অবকাঠামো’ ধ্বংস করা। তবে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই হামলায় বেসামরিক এলাকা, মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করা হয়েছে, যার ফলে নারী ও শিশুসহ ২৬ জন নিহত এবং ৪৬ জন আহত হয়েছেন।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এই হামলাকে ‘যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য’ বলে অভিহিত করেন এবং জানান, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে পাল্টা হামলা শুরু করেছে। তিনি দাবি করেন, পাকিস্তানের বিমানবাহিনী ভারতীয় আকাশসীমায় প্রবেশকারী দুটি যুদ্ধবিমান ও একটি ড্রোন ভূপাতিত করেছে। যদিও ভারত এই দাবি এখনও নিশ্চিত করেনি।

পেহেলগাম হামলা ও পাকিস্তানের অবস্থান

শাহবাজ শরিফ তার ভাষণে ২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। এই হামলায় ২৮ জন নিহত হন, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন অমুসলিম পর্যটক। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে, দাবি করে যে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) এই হামলা চালিয়েছে।

তবে শাহবাজ শরিফ এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “পেহেলগাম হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো সম্পর্ক নেই। ভারত মিথ্যা অভিযোগে আমাদের দেশকে অভিযুক্ত করছে।” তিনি এই ঘটনার একটি নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানান, যাতে পাকিস্তান পূর্ণ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। তিনি অভিযোগ করেন, ভারত এই প্রস্তাবে কোনো সাড়া দেয়নি।

পাকিস্তানের সামরিক প্রতিক্রিয়া

পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, ভারতের হামলার জবাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) বরাবর তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। আইএসপিআরের মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী জানান, ভারতের ২৪টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কোটলি, ভাওয়ালপুর, মুরিদকে, বাগ ও মুজাফফরাবাদে বেসামরিক এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পুঞ্চ-রাজৌরি এলাকায় গোলা নিক্ষেপ করা হয়েছে।

শাহবাজ শরিফ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাহসিকতার প্রশংসা করে বলেন, “আমাদের সেনারা গত রাতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে শত্রুদের মোকাবিলা করেছে। তারা প্রমাণ করেছে, পাকিস্তান কখনও পিছু হটে না।” তিনি আরও জানান, বুধবার সকালে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির একটি জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে, যেখানে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করা হবে।

মানবিক ক্ষয়ক্ষতি ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভারতের হামলায় নিহতদের মধ্যে একটি সাত বছরের শিশুর মৃত্যুর ঘটনা তুলে ধরে আবেগপ্রবণ কণ্ঠে বলেন, “একটি নিরীহ শিশুর রক্তের দাগ ভারতের হাতে লেগে আছে। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, এই রক্তের প্রতিটি ফোঁটার হিসাব নেওয়া হবে।” তিনি জানান, হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রম চলছে এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য সর্বোচ্চ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই হামলার প্রতি মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের হামলাকে ‘লজ্জাজনক’ ও ‘হতাশাজনক’ বলে অভিহিত করে উভয় পক্ষকে সংযমের আহ্বান জানিয়েছেন। পাকিস্তান জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে এই হামলার বিষয়ে অবহিত করেছে এবং জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদের আওতায় আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগের কথা জানিয়েছে।

পাকিস্তানের জনগণের ঐক্য

শাহবাজ শরিফ তার ভাষণে পাকিস্তানি জনগণের ঐক্য ও মনোবলের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, “আমাদের জনগণ আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে। আমাদের মনোবল অটুট, আমাদের সংকল্প অবিচল।” তিনি জনগণকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান এবং সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করেন।

পাকিস্তানের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শাহবাজ শরিফের এই ভাষণ ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ফেলেছে। অনেকে তার এই দৃঢ় অবস্থানের প্রশংসা করলেও কেউ কেউ এই উত্তেজনার সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এক্স প্ল্যাটফর্মে একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, “শাহবাজ শরিফের বক্তব্য জাতির মনোবল বাড়িয়েছে, তবে এই উত্তেজনা যুদ্ধে রূপ নিলে কী হবে?”

ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বর্তমান উত্তেজনা আরও তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা এবং ভারতের সামরিক প্রস্তুতি এই অঞ্চলে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। পাকিস্তান ‘আবদালি’ নামে একটি মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে, যা ৪৫০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম।

এদিকে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পাকিস্তানের পাল্টা হামলার পর সেনাবাহিনীকে ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে উভয় দেশের মধ্যে সংঘাত আরও জটিল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

শাহবাজ শরিফ তার ভাষণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “বিশ্বের উচিত এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। আমরা শান্তি চাই, কিন্তু আমাদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হলে আমরা তা মোকাবিলা করতে প্রস্তুত।” তিনি পাকিস্তানের কৌশলগত বাহিনীর প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও প্রস্তুতির উপর পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করেন।

উপসংহার

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এই সাম্প্রতিক সংঘাত দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। শাহবাজ শরিফের দৃঢ় বক্তব্য এবং পাকিস্তানের সামরিক প্রতিক্রিয়া এই অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ ছাড়া এই সংঘাত পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নিতে পারে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। পাকিস্তানের জনগণ এখন তাদের নেতৃত্বের দিকে তাকিয়ে আছে, যখন শাহবাজ শরিফ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, “শত্রুদের কখনও তাদের কুৎসিত উদ্দেশ্যে সফল হতে দেওয়া হবে না।”

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button